শিশুরা সবসময়ই নানারকম অসতর্ক মুহূর্তে নিপীড়নের শিকার হয়ে থাকে। এটা শুধু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল বিশ্বের সমস্যা না। সারা বিশ্বে উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও শিশুরা নানারকম যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। শিশুরা বয়সে ছোট এবং বাস্তব জীবনের বেশিরভাগ ব্যাপারেই তাদের ধারণা এখনো পরিপক্ব হয়নি। এই কারণে তারা নিপীড়িত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। নিপীড়ক এটা মনে করতে পারে যে, “যেহেতু শিশুরা কম বোঝে, তাদের বাঁধা দেওয়ার ক্ষমতা কম, তাই তাদের নিপীড়িত করা সহজ হবে।” WHO (World Health Organization) এর মতে, শিশুর প্রতি যৌন নিপীড়ন হচ্ছে শিশুকে যৌন কাজে নিয়োজিত করা। কোন কোন ক্ষেত্রে শিশু যৌনকাজ এবং এর মাত্রা, প্রভাব সম্পর্কে অবগত না থেকে সম্মতিও প্রদান করতে পারে। একে তখন বলা হয় Uninformed Consent. আবার অনেক সময় প্রলোভন দেখিয়েও শিশুকে যৌনকাজে নিয়োজিত করা হতে পারে। এছাড়াও শিশুর প্রতি যৌন নিপীড়নের নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে-
১। যৌন নিপীড়নের ঘটনাটি একজন প্রাপ্ত বয়স্ক এবং একজন শিশুর মধ্যে হতে পারে,
২। অনেক সময় ২জন শিশুর মধ্যেও এটা ঘটতে পারে। দুইপক্ষই শিশু হলে, এক পক্ষের শিশুই তখন নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তবে সাধারণত নিপীড়ক শিশুটি একটু পরিপক্ব মানসিকতার হতে পারে।
৩। শিশুকে জোরপূর্বক অনৈতিক কাজ, প্রস্টিটিউশন বা পর্ণোগ্রাফিক কাজে নিয়োজিত করা হতে পারে।
৪। অর্থ, ক্ষমতা বা পদমর্যাদা প্রদর্শন করতে শিশুকে যৌন নিপীড়ন করা হতে পারে।
শিশুর প্রতি যৌন নিপীড়ন কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পৃথিবীব্যাপী শিশুরা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী এবং শিশুবিশেষজ্ঞ এর বিভিন্ন কারণ চিহ্নিত করেছেন। অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে, শিশুকে দুর্বল মনে করা। নিপীড়ক মনে করে- শিশু নিপীড়িত (Abused Child) হলেও তাকে ভয়ভীতি, প্রলোভন, কথা দিয়ে ভুলিয়ে চুপ করিয়ে রাখা যাবে। অভিভাবক হিসেবে অবশ্যই আপনার চিন্তিত হওয়ার কথা। কারণ, শিশুর প্রতি যৌন নিপীড়ন সুদুর অতীতেও কম ঘটেনি। বরং, বর্তমানে এর মাত্রা বেড়েই চলেছে। নবজাতক থেকে কিশোর-কিশোরী কেউই নিরাপদ নয়।কোন শিশুরা বেশি নিপীড়নের ঝুঁকিতে থাকে?বিশেষভাবে মেয়েশিশুরা। কারণ, আমাদের সমাজব্যবস্থায় পুরুষরা ক্ষমতার অবস্থানে থাকে। নারীরা অধস্তন অবস্থানে। মেয়েশিশুরা শিশু এবং নারী হিসেবে বাড়তি ঝুঁকিতে থাকে। কারণ, নিপীড়ক তাকে বেশি দুর্বল হিসেবে বিবেচনা করে।
- সেসব শিশু এবং কিশোর-কিশোরী যাদের দায়িত্বশীল অভিভাবক অনুপস্থিত বা নেই। বাবা-মা মানসিক ভারসাম্যহীন, নেশাসক্ত বা মাদকাসক্ত।
- যেসব শিশুকে পালক/দত্তক নেওয়া হয়েছে বা যারা সৎ বাবা/মায়ের আশ্রয়ে থাকে।
- যেসব শিশু আগেও নিপীড়িত হয়েছে।
- সেসব শিশু যারা মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন, অটিস্টিক বা সহজে নিজেকে প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখে না।
- প্রতিবন্ধী শিশু
- সিঙ্গেল মা-বাবার সন্তান।
- যেসব শিশু সমাজ থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বসবাস করে।
বাংলাদেশে মাত্র গত ১৫ দিনেই কমপক্ষে ৪৭ টি শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণ চেষ্টা ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
এর মধ্যে ৩৯ টিই ছিল ধর্ষণের ঘটনা। উন্নয়ন সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এই তথ্য দিচ্ছে।
শিশুদের প্রতি এমন নির্যাতনের সংখ্যা হঠাৎ করে বাড়ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা।
যারা এসব ঘটনার শিকার, অর্থাৎ সেই শিশুদের যৌন নির্যাতন কাকে বলে, আর তাদের নিজের প্রতি তা ঘটছে কিনা, সেটি শিশুরা কীভাবে চিহ্নিত করবে? এমন স্পর্শকাতর বিষয় অভিভাবকেরা ছোট শিশুদের কীভাবে শেখাতে পারেন?
বিষয়টা জানানো দরকার কিন্তু তা কতটা মুশকিল?
কয়েকজনের মায়ের কথা
কর্মজীবী এক মা। অফিসে থাকলেও মাথার মধ্যে সারাদিন ঘুরতে থাকে তার সাত আর দশ বছর বয়সী দুটি কন্যা শিশুর কথা। কি করছে তারা সারাদিন? বলছিলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মা।
সেই উদ্বেগের কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলছিলেন, "চারপাশে আজকাল যা ঘটে তা খুবই ভীতিকর। যেমন কিছুদিন আগে ডেমরায় দুটো বাচ্চা খেলা করছিলো। ওদের লিপস্টিক কিনে দেবার কথা বলে নিয়ে গিয়েছে। তারপর রেপ করে মেরে ফেলেছে। এই খবরটা যখন দেখলাম তখন সাথে সাথেই আমার নিজের বাচ্চা দুটোর চেহারা ভেসে উঠলো। এইগুলোর কারণেই আমি সবসময় একটা টেনশনে থাকি।"
এই মা বলছেন সন্তানকে তিনি সেভাবেই প্রস্তুত করছেন। তাদের সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলছেন।
কিন্তু যৌন নির্যাতন কাকে বলে, সেটি শিশুরা কীভাবে চিহ্নিত করবে, সাত ও দশ বছর বয়সী ছোট শিশুদের এমন জটিল বিষয় তিনি কীভাবে জানাচ্ছেন?
তিনি বলছেন, "আমি ওদের শিখিয়েছি কোন স্পর্শটা ভালো আর কোনটা খারাপ। আমি আমার বাচ্চাদের সাথে একটা ওপেন রিলেশনশিপ তৈরি করার চেষ্টা করেছি। যাতে ওরা আমাকে সব কিছু বলতে পারে। তারা নিজেরাই নিচে খেলতে যায়। তাদের শিখিয়েছি কেউ যদি তোমাকে বলে আমার সাথে আসো, তোমাকে খেতে দেবো, তোমার মা বলেছে। তুমি কখনোই যাবে না।"
ছেলে বাচ্চাকে নিয়েও ভাবা দরকার
নানা উদ্বেগের কারণে সাত বছর বয়সী ছেলের দেখভালের জন্য মাহিন চৌধুরী তার চাকরিটাই ছেড়ে দিয়েছেন।বলছিলেন তাকে চোখের আড়াল হতে দেন না প্রায় কখনোই।কিন্তু ছেলে সন্তান বলে তার প্রতি যৌন নির্যাতনের কোন ঘটনা যে ঘটতে পারে তিনি সেটা ঠিক ভাবেন না।তিনি বলছেন, "সত্যি কথা বলতে কি আমার যদি মেয়ে বাচ্চা হতো তাহলে অনেক বেশি এ ব্যাপারে চিন্তিত হতাম। কিন্তু যেহেতু আমার ছেলে বাচ্চা, তুলনামূলকভাবে কিন্তু ওই চিন্তাটা একটু কমই আসে। টেনশনটা কম হয়। কিন্তু তারপরও বাচ্চার কথা চিন্তা করেই আমি চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি।"
বিষয়টি নিয়ে কথা বলা কঠিন।কিন্তু তিনিও তার বাচ্চাকে এই বিষয়টি বোঝাতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু একটি শিশুর মাথায়, যৌন নির্যাতনের ধারণাটা অনুপস্থিত।
আপত্তিকর বিষয়টিও সে বোঝে না। তাকর কাছে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা কঠিন বলে জানালেন মাহিন চৌধুরী।
তিনি বলছেন, "একটি ছোট বাচ্চাকে বিষয়টি বোঝানো খুব কঠিন। আর সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ তো আমাদের নেই। দেশের বাইরে দেখি মা বা অভিভাবকদের ট্রেইন করা হয়। সচেতনতামূলক অনেক বার্তা থাকে। আমি ছেলেকে ভালো আদর, খারাপ আদর বিষয়টির পার্থক্যটা বোঝানোর চেষ্টা করেছি।"
বাবাদের জন্য বিষয়টি কি বেশি কঠিন?
তামিম হাসানের স্ত্রী মারা গেছেন দুই বছর আগে। তিনি একজন ''সিঙ্গেল প্যারেন্ট''।
এরপর থেকে সাড়ে তিন বছরের সন্তানকে বড় করতে তিনি তার পরিবারের সহায়তা পাচ্ছেন।
মায়ের উপরে তিনি অনেকটাই নির্ভরশীল। কিন্তু শিশুটির প্রতি তিনি বাড়তি মনোযোগ দেন, কারণ তার মা নেই। তাই ছেলের ব্যাপারে তার উদ্বেগ আরও বেশি।
তবে তার মতে বাবাদের জন্য শিশুদের এই বিষয়ে শেখানো বেশ কঠিন, কারণ বাংলাদেশের সমাজে বাবাদের সেভাবে তৈরি করা হয় না। সন্তানের সাথে তার ঘনিষ্ঠতার ধরন ভিন্ন।
তিনি বলছেন, "একজন মা যেভাবে বাচ্চাদের সাথে মিশতে পারে, একজন বাবা সেভাবে পারেন না। বাবাদের সাথে ছেলেমেয়েদের একটু দূরত্ব থাকে। বাবারা অফিসের কাজে বাইরে থাকেন বেশি। তাই ততটা সময় দিতে পারেন না। আর সিঙ্গল মায়ের থেকে সিঙ্গল বাবাদের জন্য বিষয়টাতো আরও কঠিন।"
একজন চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীর দেয়া টিপস্
শিশুদের এরকম একটি বিষয়ে কীভাবে জানানো যায় সে প্রস্গে চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী ডাঃ ইশরাত শারমিন রহমান বলছেন একটি শিশু এমন প্রসঙ্গ বোঝার ক্ষমতা রাখে না।
কিন্তু তবুও তাকে জানাতে হবে। আর তার জন্য কি করা যেতে পারে সে ব্যাপারে তিনি কয়েকটি টিপস দিচ্ছেন।
তিনি বলছেন, "একটি শিশুকে তার শরীরের তিনটি জায়গা সম্পর্কে জানাতে হবে। তার ঠোঁট, গোপনাঙ্গ ও পায়ুপথ। তাকে জানাতে হবে এই তিনটা তার বিশেষ জায়গা। এখানে বাবা মা গোসল করানো বা পরিষ্কার করার সময় ছাড়া অন্য কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। কেউ সেটি করলে সে কি করবে সেটিও তাকে জানানো। সেটা বাবা মাকে যে জানাবে সেটি শেখাতে হবে। এতে বাচ্চারা সচেতন থাকবে।"
শিশুদের কি ভয় বাড়িয়ে দেয়া হবে?
ডাঃ ইশরাত শারমিন বলছেন, বিষয়টি জানানোর কাজ সঠিকভাবে করার জন্য অভিভাবকদের আগে নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে।
জিনিসটা করতে হবে একটু খেলার ছলে, ছবি এঁকে অথবা গল্প করে ধীরে ধীরে ধারণাটা তার মাথায় দিয়ে দিতে হবে।
বড় বাচ্চাদের ক্ষেত্রে মুখে বলা যেতে পারে। কিন্তু শিশুরা সবকিছু ভুলে যায়। তাদের মধ্যে সন্দেহ কম, তাই তাদের বিষয়টি মনে করিয়ে দিতে হবে।
তিনি বলছেন, "শিশুর আচরণ পরিবর্তন খেয়াল করতে হবে। বাচ্চার আচরণ থেকেও অনেক সময় অনেক কিছু বোঝা যায়। সে যদি কাউকে দেখে ভয় পায়, কারো কোলে যেতে না চায়, তাকে জোর করা উচিৎ নয়। যে বাচ্চা বিছানা ভেজানো বন্ধ করে দিয়েছে, সে যদি হঠাৎ আবার তা করে। সে যদি ভয় পেয়ে চমকে ওঠে বা রাতে দু:স্বপ্ন দেখছে, এমন পরিবর্তন খেয়াল করতে হবে।"
শিশুর কথা শুনতে হবে ও তাকে বিশ্বাস করতে হবে
বাংলাদেশে শিশুদের কথা না শোনার একটি প্রবণতা রয়েছে।
ডাঃ ইশরাত শারমিন বলছেন, "বাচ্চারা যদি এই বিষয়ক কিছু কখনো বলে সেটিকে সিরিয়াসলি নিতে হবে, বাবামাকে বিশ্বাস করতে হবে। কারণ বাচ্চারা যতরকম গল্প বানিয়ে বলুক না কেন এই বিষয়ে বানিয়ে কথা বলার ক্ষমতা তার থাকার কথা নয়।"
তিনি বলছেন, "আমার ক্লায়েন্টদের দেখে বলছি, অনেক বাবা মা বিষয়টি বিশ্বাস করতে চান না, মানতে চান না। অনেক সময় বলেন তুমি বানিয়ে বলছ। এরকম হলে শিশুরা তার বলার জায়গাটি হারিয়ে ফেলে। এতে নির্যাতক ব্যক্তি আরও সুযোগ পায়।"
সামাজিক সম্পর্কের কথা কতটা ভাববেন?
ডাঃ ইশরাত শারমিন বলছেন, শিশুকে কার কাছে দিচ্ছেন, বাবা মায়েদের সেদিকে নজর রাখা উচিত।
কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্য, আত্মীয়, প্রতিবেশী অথবা ঘনিষ্ঠদের দ্বারাই যৌন নির্যাতনের ঘটনা বেশি ঘটে।
কিন্তু হঠাৎ করে বাচ্চাদের সচেতন করতে গিয়ে নিজের পরিবারের সদস্য অথবা আত্মীয়দের সন্দেহ করা শুরু করবেন কিনা সে ব্যাপারেও ভাবেন অনেকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক সামিনা লুৎফা বলছেন, "সামাজিক সম্পর্ক নষ্ট করার ভয়ে অনেক সময় এগুলো নিয়ে সবাই চুপ করে থাকে। কিন্তু এগুলোকে নিয়ে পরিবারের সবাইকে একসাথে বসে কথা বলতে হবে যে আমাদের শিশুরা কারো কাছে নিরাপদ নয়।"
তিনি বলছেন, "আপনি কেন ভাবতে যাবেন আপনার ভাইকে বা বাবাকেও আপনার সন্দেহ করা প্রয়োজন। প্রয়োজন নেই। কিন্তু এই আলোচনাটা যদি পরিবারে খাবার টেবিলে হয়ে যায়, তাহলে কিন্তু সকলেই এই বিষয়টা সম্পর্কে সচেতন থাকে।"