সদ্য মা হয়েছে এমন একজন বলছিল “ছোটবেলা থেকেই বাবা-মার সাথে আমার খুব ঘনিষ্ট ও মজবুত সম্পর্ক ছিল। কিন্তু যখন আমি চাকরি করা শুরু করলাম, এরপর বিয়ে করলাম এবং নিজের একটা সংসার তৈরি হল তখন তাদের সাথে আগের মত যোগাযোগ রাখাটা আমার পক্ষে খুব কঠিন হয়ে দাড়ায়। কিন্তু মা হওয়ার পর আমি আমার সন্তানের মাধ্যমে বাবা-মার সাথে সেই পুরাতন সম্পর্কটি ফিরে পাবার আরেকটি সুযোগ পাই। প্যারেন্টস চয়েস এওয়ার্ড বিজয়ী ডঃ লিলিয়ান কারসন বলেন দাদা-দাদি, নানা নানিরা জীবনকে পরিবর্তন করার এক মহান ক্ষমতা রাখেন। তাদের সাথে সময় কাটাতে পারলে আপনার সন্তানের মূল্যবোধ বাড়বে,তারা শিখতে পারবে নৈতিকতা। আপনার সন্তানেরা দাদা-দাদি, নানা-নানির কাছ থেকে তাদের বহুদিনের বিভিন্ন কাজের অভিজ্ঞতার গল্প শুনলে যেমন বাড়বে তাদের জ্ঞান তেমনি বাড়বে কাজের দক্ষতা। তারা জানবে ইতিহাস এবং পরিচিত হতে পারবে তাদের সংস্কৃতির সাথে।
১। দাদা-দাদি,নানা-নানিরা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পাঠ শেখানঃ
তাদের জ্ঞান ও জীবনের নানা অভিজ্ঞতার গল্প তারা নাতি-নাত্নিদের শোনান। এতে আমাদের শিশুরা পরিবাবের অতীতের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে এবং জানতে পারে সেই যুগে মানুষের জীবন কেমন ছিল। আমাদের ছেলেমেয়েরা তাদের পরিবারের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানার সুযোগ পায়, যা তাদের পরিবার পরিচয় সম্পর্কে একটি পরিপক্ক ধারনা দেয২.পরিবারের মধ্যে সমৃদ্ধ বন্ধন তৈরি করে।
২। নাতি নাত্নির সাথে সম্পর্কঃ
নাতি-নাত্নির সাথে ইতিবাচক সম্পর্ক দাদা-দাদি,নানা-নানিদের যেমন দেয় আনন্দ তেমনি দেয় শেষ বয়সে বেঁচে থাকার একটি উদ্দেশ্য। নাতি-নাত্নিদের যত্ন নিতে পেরে তারা সেসময় জীবনের অর্থ খুঁজে পান যখন তারা মনে করেন যে পরিবার ও সমাজকে দেয়ার মত তাদের কাছে কিছুই নেই। সন্তানের বেড়ে ওঠার সময় বাবা-মাকে পাশে পেলে তাদের সাথে আপনার বন্ধনও আবার আগেরমত নিবিড় করার আরেকটি সুযোগ পাওয়া যায়। এমনকি শশুর-শাশুরির সাথেও সূসম্পর্ক তৈরি হয়। আপনার সন্তানরাও বয়স্ক মানুষদের সাথে সময় কাটাতে পারলে,তাদের আদর-যত্ন ও পরিচর্যা পেলে অনেক উপকৃত হবে। এটা জেনে তারা নিরাপত্তাবোধ করবে যে তাদের বাবা-মার পাশাপাশি আরও অনেকে আছে যাদের উপর তারা নির্ভর করতে পারে।
৩। পারিবারিক কলহে নিরপেক্ষতাঃ
পারিবারিক কলহের সময় দাদা-দাদি, নানা-নানিরা সান্তনার প্রধান উৎস হতে পারেবাবা-মায়েরা যখন তাদের বিবাহিত জীবনে অসুবিধার সম্মুখীন হন তখন দাদা-দাদি অথবা নানা-নানির কাছে আপনার সন্তান আশ্রয় ও সান্ত্বনা খুঁজে পেতে পারে। সেজন্যই পারিপারিক ঝগড়ার সময় আপনার বাবা-মা কিংবা শশুর-শাশুরির যতটা সম্ভব নিরপেক্ষ থাকা ও কখনও পক্ষপাতিত্ব না করাটি খুবই জরুরী। নাতিনাত্নিরাও উপকৃত হয় দাদা-দাদি কিংবা নানা-নানির উপর আস্থা রাখতে পেরে যখন বাবা-মায়ের মধ্যে কেউ একজন নিজের দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়।
৪। দাদা-দাদি কিংবা নানা-নানিরা পিতামাতার কাছেও সবচেয়ে বিশ্বস্তঃ
প্রায়সময়ই কর্মজীবন ও সংসারের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখা পিতামাতার পক্ষে কঠিন হয়ে দাড়ায়। এমন কঠিন সময়ে বাবা মাদের সঠিক পরামর্শদাতা হিসেবে ভুমিকা পালন করেন দাদা-দাদি,নানা-নানিরা। কোন কাজটিকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিৎ, কোন কাজটি করলে সময় বাচবে তা নির্ধারণ করতে তারা সহায়তা করেন। তাদের বদৌলতে বাবা মারা পারিবারিক জীবন থেকে ছোট্ট বিরতি নিয়ে নিজেদের মধ্যে একান্ত সময় কাটানোরও সুযোগ পান। সর্বোপরি বাবামার সাথে আপনার খুব ভাল যোগাযোগ থাকা উচিৎ এবং সন্তানের পরিচর্যার ব্যাপারে আপনার প্রত্যাশা কি তা তাদের জানানো উচিত, যেহেতু আপনার অনুপস্থিতিতে শিশুরা তাদের কাছেই থাকে।
৫। আদরের পরিমান ও এর কারনঃ
আমাদের সন্তানেরা তাদের নানা-নানি,দাদা-দাদির কাছে নিজেকে “বিশেষ” এবং “আদুরে” অনুভব করে আমরা মাঝে মাঝেই হয়তোবা চিন্তা করি নানা-নানি,দাদা-দাদিরা তাদের নাতিনাত্নিদের অতিরিক্ত আদর দিয়ে নষ্ট করে ফেলেন। আসলে জীবনের এই পর্যায়ে এসে দাদা-দাদি,নানা-নানিরা কোন দায়িত্ববোধ কিংবা চাপ ছাড়াই তাদের নাতি-নাত্নিদের সাথে কাটানো সময়টি উপভোগ করতে চান। সে কারণেই তারা তাদের নাতিনাত্নিদের অতিরিক্ত আদর করতে চান, দিনের পুরো সময়টাই তাদের জন্য উৎসর্গ করে দেন এবং নাতি-নাত্নিরা যে তাদের কাছে কতটা প্রিয় ও মূল্যবান তা তাদের অনুভব করানোর চেষ্টা করেন। আপনার সন্তানরাও তাদের প্রিয় “দাদুভাই”, “নানুভাই” এর সাথে সময় কাটাতে পেরে খুব আনন্দ পায় কারণ যতক্ষণ তারা তাদের নানা-নানি,দাদা-দাদির সাথে থাকে ততক্ষন তারা বাঁধনহারা হয়ে থাকতে পারে,যা খুশি তাই করতে পারে।
আমাদের সন্তানদের তাদের দাদা-দাদি,নানা-নানির সাথে স্বাধীনভাবে কিছু মুহূর্ত কাটাতে দিলে তা তাদের মানসিক দিক দিয়েও অনেক উপকৃত করবে। এটা তাদেরকে অন্যান্য মুরুব্বিদের সাথে মজার কিছু সময় কাটানোর সুযোগ করে দিবে এবং তার পাশাপাশি বাবা মার নজরদারির ভেতরে থাকা থেকে কিছুতা বিরতি দিবে। মাঝেমধ্যে শিশুদের এইধরনের বিনোদনের দরকার হয় কিন্তু অবশ্যই এর নির্দিষ্ট কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছখুব বেশি ছেলেমেয়েরা তাদের নানা-নানি,দাদা-দাদির সাথে এমন সুসম্পর্ক গড়ার সুযোগ পায়না। অনেকে ছোটবেলাতেই তাদের হারিয়ে ফেলে, অনেকে বেঁচে থাকা সত্ত্বেও তাদের নানা-নানি,দাদা-দাদির সাথে দেখা করতে পারে না, আবার কারও কারও পরিবারের বিভিন্ন পরিস্থিতির কারণে দেখা করার সুযোগ হয়ে ওঠে না। তাই যেসব শিশুদের কাছে তাদের নানা-নানি,দাদা-দাদিরা আছেন আমাদের উচিৎ সেসব সৌভাগ্যবানদের সুযোগ করে দেয়া যাতে তারা তাদের প্রিয় মানুষগুলোর সাথে আনন্দঘন কিছু সময় কাটাতে পারে এবংসঙ্গ উপভোগ করতে পারে।