গর্ভাবস্থার সময় প্রত্যেক মেয়েরই এই কথাটা মনে হয়। তবে আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে এই ইচ্ছে সহজেই পূরণ করা যায়। কারণ মেডিকেল সায়েন্সের দৌলতে এসব খুঁটিনাটি আপনার হাতের মুঠোয়, শুধু জেনে নেওয়ার অপেক্ষা। চলুন জেনে নেওয়া যাক কোন কোন লক্ষণ দেখলে আপনি সহজেই বুঝতে পারবেন মা হওয়ার সেই মুহূর্ত আর বেশি দূরে নেই,
#1. মিউকাস প্লাগ বেরিয়ে আসা: মিউকাস প্লাগ জরায়ুর মুখ আটকে রাখতে সাহায্য করে। ভ্রুণ যতদিন গর্ভে বড় হয়, ততদিন মিউকাস প্লাগের দায়িত্ব হল জরায়ুর মধ্যে ভ্রুণকে বাইরের জীবাণু থেকে রক্ষা করে। ভ্রুণের ইমপ্লান্টের পর সার্ভিক্সের গ্ৰন্থি থেকে একরকম থকথকে তরল পদার্থ বের হতে থাকে। এই তরল পদার্থই মিউকাস প্লাগ তৈরি করে। গর্ভাবস্থার মধ্যে কোনও সময় এই মিউকাস প্লাগ বেরিয়ে এলে বুঝতে হবে মা হওয়ার সেই মুহূর্ত আর বেশি দেরি নেই। মিউকাস প্লাগ লম্বা আকৃতির হয় আর পুরোটাই একইসঙ্গে বেরিয়ে আসে। কিন্তু কেন এমন হয়? বিশেষজ্ঞদের মত, শিশুর যখন বেরিয়ে আসার সময় হয়ে গিয়েছে, তখন সে তার ছোট্ট মাথা দিয়ে নীচের দিকে অল্প চাপ দেয়। তাতেই মিউকাস প্লাগ তার জায়গা থেকে সরে যায়। অনেকের ক্ষেত্রে প্রসবযন্ত্রণা না শুরু হওয়া পর্যন্ত মিউকাস প্লাগ বের হয় না। আবার অনেকের ক্ষেত্রে প্রসবযন্ত্রণা শুরু হওয়ার আগের দিনই প্লাগটি বেরিয়ে আসে।
#2. শিশু নীচের দিকে নামতে থাকে: সাধারণভাবে প্রসবযন্ত্রণা শুরু হওয়ার দুই সপ্তাহ আগে শিশুর মাথা পেলভিসের মধ্যে একটু নীচে নেমে যায়। আসলে আপনার ছোট্ট সোনা এইবার বেরিয়ে আসতে চাইছে। এই ঘটনা কীভাবে বুঝবেন? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সময় শিশুর শরীর নীচের দিকে নেমে আসায় ফুসফুস তার পুরোনো জায়গা অল্প হলেও ফিরে পায়। তাই এই সময় প্রেগন্যান্ট মহিলাদের শ্বাস নিতে একটু সুবিধা হয়। তা ছাড়া এমনটা হওয়ার পর আগের মতো সহজভাবে হাঁটা যায় না। ছোট ছোট পা ফেলে হাঁটতে হয়। শুধু এটুকুই না, আগে পেটটা যেমন ফোলা ছিল, এক্ষেত্রে ফোলাভাবটা নীচের দিকে নেমে যায়। তবে সবার ক্ষেত্রেই যে এমনটা হবে তা কিন্তু নয়। অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা যায় প্রসবযন্ত্রণা শুরু না হওয়া পর্যন্ত শিশু নীচের দিকে নামেই না। তবে প্রথমবার প্রেগন্যান্ট হলে প্রায় সবার ক্ষেত্রেই এমন লক্ষণ দেখা যায়।
#3. সারভিক্সের মুখ বড় হতে থাকে: মা হওয়ার সেই মুহূর্ত যখন বেশি দূরে নেই, তখন সারভিক্সের মুখ ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। সারভিক্স হল শিশুর জন্ম নেওয়ার পথ। সাধারণ অবস্থায় এটি এক থেকে দুই সেমির মধ্যে থাকে। কিন্তু প্রসবযন্ত্রণা শুরু হওয়ার কয়েকদিন আগে এর মুখ তিন-চার সেমির মতো বড় হয়ে যায়। সময় এগোলে আরও বড় হতে থাকে সারভিক্সের মুখ। সারভিক্সের মুখ বড় হচ্ছে কি না, তা ডাক্তার নিয়মিত পরীক্ষা করে থাকেন। বিশেষত ৩৭-৩৮তম সপ্তাহে এসে চিকিৎসকরা নিয়মিত নজর রাখেন এদিকে। প্রসবের সময় বাচ্চার বেরিয়ে আসার জন্য সারভিক্সের মুখ ১০ সেমি বড় হয়। তাই সারভিক্সের মুখ তিন-চার সেমি বড় হলেই শুভ মুহূর্তের কাউন্টডাউন শুরু করাই যায়।
#4. বারেবারে প্রস্রাবের বেগ আসা: প্রায় সব মায়ের ক্ষেত্রেই প্রসবযন্ত্রণা শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে এই লক্ষণ দেখা যায়। এইসময় বারে বারে বাথরুম যাওয়ার দরকার হয়ে পড়ে। তবে প্রস্রাবের সঙ্গে শিশুর কী সম্পর্ক, তাই ভাবছেন তো? আসলে প্রসবযন্ত্রণা শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে শিশু কিছুটা নীচের দিকে নেমে আসে। এর ফলে চাপ পড়ে মূত্রথলিতে। তাই ঘনঘন ওয়াশরুম যেতে হয়।
#5. সারভিক্স পাতলা হতে থাকে: বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারভিক্সের মুখ বন্ধ থাকে বলেই গর্ভে ভ্রুণ সুরক্ষিত থাকে। কিন্তু সারভিক্সের মুখ যখন ধীরে ধীরে খুলতে থাকে, তখন একইসঙ্গে এর পুরুভাব চলে যায়। তাই এটি পাতলা হতে থাকে। প্রসবযন্ত্রণা শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে সারভিক্সের ধীরে ধীরে পাতলা হওয়ার ঘটনা ঘটে। তবে প্রেগন্যান্ট মহিলারা কি নিজে থেকে এটি বুঝতে পারবেন? এক্ষেত্রে কিন্তু উত্তর হল– না। একমাত্র বিশেষজ্ঞই মেডিকেল টেস্টের মাধ্যমে জানতে পারেন সারভিক্সের অবস্থা। আসলে প্রসবের সময় শিশু যাতে সহজে বেরিয়ে আসতে পারে তার জন্য প্রসবের কিছুদিন আগে থেকেই মায়ের শরীর প্রস্তুতি নেয়। শিশুর ছোট্ট শরীর যাতে সারভিক্সের পুরুভাবের জন্য বাধা না পায়, তাই এটি পাতলা হয়ে যেতে থাকে।
6. জরায়ুর পেশিতে ব্যথা: প্রসবযন্ত্রণা শুরু হওয়ার আগে গর্ভের পেশিতে ব্যথা হওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ। ব্যথাটা যদিও সবার ক্ষেত্রে সমান নয়। কারও ক্ষেত্রে পিরিয়ডের সময়ের মাসল ক্র্যাম্পিংয়ের মতো ব্যথা হয়। আবার কারও কারও মনে হয়, জরায়ুর পেশিগুলো সংকুচিত হয়ে অল্পক্ষণ পড়েই ঠিক হয়ে যাচ্ছে। তবে এই ব্যথা সহ্যক্ষমতার মধ্যে থাকলে আর অনিয়মিত হলে, একে ‘ফলস্ লেবার’ বলা হয়। এটা ‘ফলস্’ হলে ‘ট্রু’ লেবার কোনটা? বিশেষজ্ঞরা বলছেন দশ মিনিটের কম সময়ে যদি এই রকম ব্যথা বারবার হয় বুঝতে হবে সেটাই ট্রু লেবার অর্থাৎ প্রসবযন্ত্রণা। তাই ফলস্ লেবার থেকেই মুহূর্ত গোনা শুরু হোক ট্রু লেবরের জন্য।
#7. হাড়ের জয়েন্ট শিথিল হয়ে যাওয়া: হাড়ের জয়েন্ট আগের তুলনায় শিথিল হয়ে গিয়েছে কি না, এটা আপনি দেখতে পাবেন না, তবে অনুভব করতে পারবেন।প্রেগন্যান্সি শুরুর সময় থেকেই মেয়েদের শরীরে রিলাক্সিন হরমোনের ক্ষরণ শুরু হয়। এই হরমোন হাড়ের বিভিন্ন জয়েন্টগুলোকে একটু শিথিল করে দেয়। এর ফলে শরীরে আরামের অনুভূতি আসে। প্রসবযন্ত্রণা শুরু হওয়ার আগে এই হরমোনের ক্ষরণের ফলে আরামের অনুভূতি হতে থাকে। এমন অনুভূতি হলে আপনার মা হওয়ার মুহূর্ত কিন্তু আর বেশি দূরে নেই। কিন্তু কেন এমনভাবে হাড়ের জয়েন্টগুলো শিথিল হয়ে পড়ে? বিশেষজ্ঞদের মতে, এটাই তো মায়ের শরীর করে থাকে। তার সন্তানের পৃথিবীতে আসতে যাতে কোনও সমস্যা না হয়, তাই হাড়ের জয়েন্ট শিথিল জন্মের পথকে সুগম করে।
#8.ওয়াটার ব্রেকিং: প্রসবের সময় এলে গর্ভে যে অ্যামনিওটিক মেমব্রেন (amniotic membrane) বা পর্দা থাকে সেগুলো ফেটে গিয়ে অ্যামনিওটিক তরল বেরিয়ে আসে। অ্যামনিওটিক তরলের কোনও রং আর গন্ধ নেই। রং নেই বলে প্রস্রাবের থেকে একে আলাদাভাবে বোঝা শক্ত। তবে বোঝার একটা উপায় আছে। অ্যামনিওটিক তরল খুব ধীরে ধীরে নিঃসৃত হয়। তা ছাড়া এর গন্ধ নেই বলে একে চেনা সম্ভব। অ্যামনিওটিক তরল ক্ষরণ মানেই কিন্তু প্রসবের সময় এসে গিয়েছে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, কারণ যে কোনও মুহূর্তে শুরু হতে পারে প্রসবযন্ত্রণা।
দেখলেন তো! কয়েক মিনিটের ফেরেই জেনে নেওয়া গেল প্রসবযন্ত্রণা শুরু হওয়ার আগে কী কী লক্ষণ দেখা দিতে পারে। তাহলে সন্তানকে পৃথিবীতে আনার সময় হয়ে এলে প্রথম খবরটা কিন্তু আপনিই পাচ্ছেন!