ষড়ঋতুর দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। কিন্তু বর্তমানে প্রায় সারা বছরেই ঠান্ডা-গরমের দোলাচলে থাকে আমাদের প্রকৃতি। ঋতুর এই পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, ধুলাবালি আর বৃষ্টিপাতের তারতম্যে আমাদের অনেকেরই বিভিন্ন রকম রোগ হয়ে থাকে।
এছাড়া বাতাসে ভেসে বেড়ানো ধুলিকনা, গাড়ির ধোঁয়া নিঃশ্বাসের সঙ্গে আমাদের শ্বাসনালীতে প্রবেশ করে শ্বাসতন্ত্রে সমস্যার সৃষ্টি করে। এতে যাদের নাকে সমস্যাসহ অ্যালার্জির সমস্যা রয়েছে, তারা শ্বাসতন্ত্রে নানা অসুখে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন।
গরম-ঠান্ডার প্রভাবে আমাদের সবচেয়ে বেশি দেখা দেয় সর্দি-কাশি বা জ্বর। এই সময়টাতে আরও একটি ভাইরাস রোগের প্রাদুর্ভাব হতে পারে, যাকে বলে সিজনাল ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জা। ফ্লুতে আক্রান্ত হলে আমাদের প্রায়ই দেখা যায় ২/৩ দিন নাক বন্ধ থাকে বা নাক দিয়ে পানি ঝরে। গলাব্যথা ও খুসখুস করে, শুকনো কাশি থাকে, জ্বর থাকতে পারে। অনেকে সিজনাল ফ্লু কে তেমন একটা পাত্তা দেন না আবার অনেকেই ভীষণ কাবু হয়ে পড়েন৷ অনেকে আবার সিজনাল ফ্লু এর ব্যাপারটা হয়তো ঠিকঠাক বুঝে উঠতে না পেরে হিমশিম খান।
সিজনাল ফ্লু এর ব্যাপারে জানতে হলে সবার আগে জানতে হবে এর লক্ষণগুলো সম্পর্কে।
সিজনাল বিভিন্ন ফ্লু এর লক্ষণ:
সিজলান ফ্লু ও সাধারণ সর্দি-কাশির লক্ষণ প্রায় একই রকম। তবে সাধারণ সর্দি-কাশির তুলনায় ফ্লু এর লক্ষণগুলোর তীব্রতা বেশি হতে পারে এবং সেরে উঠতেও বেশি সময় লাগতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে কখনো কখনো লক্ষণগুলো বড়দের তুলনায় বেশিদিন ধরে থাকতে পারে।
এ ছাড়া ফ্লুতে শিশুদের ক্ষেত্রে জ্বরের পাশাপাশি ডায়রিয়া ও বমির সমস্যা বেশি দেখা যায়। সেই সাথে শিশুর কান ব্যথা হতে পারে এবং চঞ্চলতা কমে যেতে পারে। তেমন কোন ঔষধ এই ক্ষেত্রে আমাদের গ্রহণ করা তেমন দরকার পরে না। বাসায় থেকে সাধারণ কিছু প্রাথমিক চিকিৎসার মাধ্যমেই হতে পারে এসব রোগের সমাধান।
সিজনাল ফ্লু রোধে ঘরোয়া বিভিন্ন উপায় হতে পারে-
- বিশ্রাম ও পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম
- শরীর উষ্ণ রাখা
- প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা। পানির পাশাপাশি তরল খাবারও উপকারী। যেমনঃ ফলের জুস, চিড়া পানি, ডাবের পানি, স্যুপ ইত্যাদি। এক্ষেত্রে বেশ কিছু ভেষজ শরবতও ভালো কাজ করে।
- গলা ব্যথা উপশমের জন্য লবণ মিশিয়ে কুসুম গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করা। তবে ছোটো শিশুরা ঠিকমতো গড়গড়া করতে পারে না বলে তাদের ক্ষেত্রে এই পরামর্শ প্রযোজ্য নয়।
- কাশি উপশমের জন্য মধু গ্রহণ করা যেতে পারে। অবশ্যই এক্ষেত্রে খাঁটি মধু হওয়া আবশ্যক। তবে ১ বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের জন্য এই পরামর্শ প্রযোজ্য নয়।
যদি সিজনাল ফ্লু মারাত্মক আকার ধারণ করে তবে ঔষধ সেবনের পূর্বে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ। যেমনঃ
- ঔষধ সেবনের আগে তার গায়ে লাগানো লেবেল দেখে নিবেন। ঔষধের সাথে থাকা নির্দেশনাগুলো মেনে চলবেন।
- অনেক সর্দি-কাশির ঔষধের মধ্যে ব্যথানাশক ঔষধের উপাদান থাকে। যেমনঃ প্যারাসিটামল, আইবুপ্রফেন ইত্যাদি। সেক্ষেত্রে আলাদা করে ব্যথানাশক ব্যবহার করলে ঔষধের মাত্রা ক্ষতিকর পর্যায়ে চলে যেতে পারে।
- গর্ভাবস্থায় অনেক ঔষধ সেবন করাই মা ও গর্ভের শিশুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া গর্ভবতী মায়েদের যেকোনো ঔষধ সেবন করা থেকে বিরত থাকা উচিত।
- দুই বছরের ছোটো শিশুদের সর্দি-কাশির জন্য কোনো ঔষধ দেওয়া উচিত নয়।
- শিশুদের অ্যাসপিরিন জাতীয় ঔষধ দেওয়া উচিত নয়।
সিজনাল ফ্লু হলে তেমন ঔষধের দরকার না হলেও, নিচের লক্ষণগুলো দেখা গেলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে-
- ফ্লু এর ক্ষেত্রে সাত দিনের বেশি এবং সর্দি-কাশির ক্ষেত্রে তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে লক্ষণ থাকলে
- তিন মাসের কম বয়সী শিশুর জ্বর আসলে অথবা খুব নিস্তেজ হয়ে পড়লে, কিংবা যেকোনো বয়সী শিশুকে নিয়ে শঙ্কা থাকলে
- বয়স ৬৫ বছরের বেশি হলে কিংবা গর্ভবতী হলে
- দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যা থাকলে। যেমন: ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, কিডনি রোগ, ফুসফুসের রোগ ইত্যাদি।
- শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এমন চিকিৎসা নিলে। যেমনঃ কেমোথেরাপি ও লম্বা সময় ধরে স্টেরয়েড সেবন
- জ্বরের তীব্রতা অত্যাধিক হলে অথবা জ্বরের সাথে কাঁপুনি থাকলে
বয়স ভেদে সিজনাল ফ্লু এর ক্ষেত্রে চিকিৎসা পদ্ধতিতেও কিছুটা হেরফের। তাই বয়সভেদে যেসব লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা নিতে হবে তা জানা জরুরি। তেমনই কিছু লক্ষণ নিম্নরূপ –
শিশুদের ক্ষেত্রে-
- খিঁচুনি
- ঠোঁট ও মুখ নীল হয়ে যাওয়া
- পানিশূন্যতা। এর কিছু লক্ষণ হলো—৮ ঘন্টায় একবারও প্রস্রাব না হওয়া, মুখ শুকিয়ে যাওয়া এবং কান্না করলে চোখে পানি না আসা। ছোটো শিশুদের মাথার সামনের দিক বসে যেতে পারে
- সজাগ অবস্থাতেও পুরোপুরি সচেতন না থাকা এবং অন্যদের সাথে না মেশা
- দ্রুত শ্বাস নেওয়া অথবা শ্বাসকষ্ট হওয়া
- শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে পাঁজরের হাড় ভেতরে ঢুকে যাওয়া
- বুকে ব্যথা
- মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথা। ব্যাথা এতটাই তীব্র হয় যে শিশু হাঁটাচলা করতে চায় না
- জ্বর ১০৪° ফারেনহাইট এর ওপরে চলে যাওয়া
প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে-
- শ্বাসকষ্ট
- বুকে অথবা তলপেটে ক্রমাগত ব্যথা অথবা চাপ লাগা
- ক্রমাগত মাথা ঘোরানো, বিভ্রান্তি ও ঝিমুনি
- খিঁচুনি
- প্রস্রাব না হওয়া
- মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথা
- প্রচণ্ড দুর্বলতা ও অস্থিরতা
- কাশির সাথে রক্ত যাওয়া
এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদী অন্যান্য রোগের লক্ষণগুলো বেড়ে গেলে, জ্বর-কাশি কিছুটা কমার পরে আবার ফিরে আসলে অথবা হঠাৎ করে লক্ষণগুলো বেড়ে গেলে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।
ফ্লু ও সাধারণ সর্দি-কাশি প্রতিরোধের উপায়:
এই রোগগুলো সহজেই একজন থেকে আরেকজনে ছড়াতে পারে। তবে সহজ কিছু পদক্ষেপ দিয়ে তা ঠেকানো সম্ভব। সিজলান ফ্লু এর ক্ষেত্রে প্রথম পাঁচ দিনে ইনফেকশন ছড়ানোর সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে। সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত ব্যক্তির লক্ষণগুলো পুরোপুরি সেরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত অন্যদের মধ্যে জীবাণু ছড়াতে পারে।
ঋতু পরিবর্তনের এই সময়গুলোতে আমাদের সবারই কিছু সাবধানতা মেনে চলা জরুরী। যেমনঃ
- যথাসম্ভব ধুলাবালি পরিহার করা উচিৎ। বাইরে বের হলে মুখে মাস্ক ব্যবহার করা উচিৎ।
- অতিরিক্ত গরমে বাইরে যাওয়ার প্রবণতা এড়িয়ে চলা প্রয়োজন।
- ঘাম হলে তা সাথে সাথে মুছে ফেলতে হবে।
- ভিটামিনযুক্ত ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার বেশি করে গ্রহণ করতে হবে।
- বাইরের খোলা খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। খাস ফুডের ফ্রোজেন স্ন্যাকস আপনাদের এই চাহিদা পূরণ করতে পারে।
- হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় রুমাল ব্যবহার করতে হবে।
- ফ্লু খুব ছোঁয়াচে তাই জনবহুল জায়গাগুলোতে যথাসম্ভব সতর্ক থাকতে হবে।
- যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক কম, তাদের জনবহুল জায়গা যথাসম্ভব এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।
- সারাদিন পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। দৈনিক আট থেকে ১০ গ্লাস পানি পান করা আবশ্যক।
- ভিটামিন সি-যুক্ত ফলমূল ও শাকসবজি বেশি করে গ্রহণ করতে হবে।
- ফ্রিজের অতিরিক্ত ঠাণ্ডা খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
- বাইরে থেকে এসে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে।
- খাবার খাওয়ার আগে ভালো করে হাত ধুতে হবে।
- পর্যাপ্ত সময় ঘুমাতে হবে। দৈনিক অন্তত আট ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন।
রোগ পরবর্তী জটিলতা:
সর্দি-কাশি সাধারণত ৭–১০ দিনের মধ্যে সেরে যায়। তবে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম কিংবা অ্যাজমার মতো শ্বাস-প্রশ্বাসের রোগ আছে, তাদের সাধারণ সর্দি-কাশি থেকেও নিউমোনিয়ার মতো জটিলতায় ভোগার সম্ভাবনা থাকে।
অন্যদিকে ফ্লু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুই সপ্তাহের মধ্যে সেরে যায়। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে নিউমোনিয়াসহ নানান জটিলতা হতে পারে। এমনকি কিছু জটিলতা থেকে মৃত্যু হতে পারে।
ফ্লু এর জটিলতার মধ্যে রয়েছে –
- নিউমোনিয়া
- সাইনুসাইটিস
- কানের ইনফেকশন
- হার্টের প্রদাহ বা মায়োকার্ডাইটিস
- ব্রেইনে প্রদাহ বা এনসেফালাইটিস
- মাংসপেশির প্রদাহ
- ফুসফুস ও কিডনির মতো একাধিক অঙ্গের কাজ মারাত্মকভাবে বাঁধাগ্রস্ত হওয়া
- গুরুতর ইনফেকশন থেকে শরীরে ‘সেপসিস’ নামক জীবনঘাতী প্রতিক্রিয়া তৈরি হওয়া
এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদী রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ফ্লু হলে সেটি রোগের তীব্রতা বাড়িয়ে দিতে পারে। যেমন, অ্যাজমা বা হাঁপানি রোগীদের অ্যাজমার অ্যাটাক হতে পারে এবং হার্টের রোগীদের অবস্থার অবনতি হতে পারে।
যাদের জন্য সিজনাল ফ্লু বেশী ঝুঁকিপূর্ণ
যে কেউই ফ্লুতে আক্রান্ত হতে পারেন এবং ফ্লু সংক্রান্ত জটিলতায় ভুগতে পারেন। তবে কিছু মানুষের ক্ষেত্রে ফ্লু হওয়ার পর ভোগার সম্ভাবনা বেশি। যেমন—
- ৬৫ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী ব্যক্তি
- গর্ভবতী নারী
- পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু
- ইতোমধ্যে কোনো রোগে ভুগছেন এমন ব্যক্তি
আপনার একটু সচেতনতাই পারে আপনাকে ও আপনার আশেপাশের সবাইকে বিভিন্ন রকম সিজনাল ফ্লু থেকে রক্ষা করতে। তাই এই সময়ে নিজে সচেতন থাকুন এবং পরিবারকেও সচেতন রাখুন। সেই সাথে গ্রহণ করুন স্বাস্থ্যসম্মত খাবার। খাবার ক্রয়ের ক্ষেত্রে অবশ্যই সচেতন থাকা আবশ্যক। তাই বিশ্বস্ত উৎস থেকে খাদ্য সামগ্রী ক্রয় করুন।