হাঁপানি বা অ্যাজমা
হাঁপানি একটি দীর্ঘমেয়াদী রোগ যার মূল লক্ষণ হল শ্বাস কষ্ট ও সাঁসাঁ শব্দে নিঃশ্বাস ফেলা।হাঁপানি আক্রমণের সময় শ্বাসনালীর আস্তরণ ফুলে যায়, যার ফলে শ্বাসনালী এতটাই সংকীর্ণ হয়ে যায় যে প্রশ্বাস ও নি:শ্বাসে শ্বাসবায়ুর গতি অনেকটাই কমে যায়। হাঁপানির কারণ এখনো পুরোটা বোঝা যায়নি। তবুও, অ্যালার্জি, তামাকের ধোঁয়া ও রাসায়নিক উত্তেজক পদার্থে হাঁপানি ক্রমশ: বৃদ্ধি পায় ও এগুলোকে হাঁপানি রোগের মূল কারণ হিসেবে ধারা হয়। হাঁপানির পুরোপুরি নিরাময় সম্ভব নয়, কিন্তু যথাযথ পরিচালনায় এই রোগটিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। উন্নত মানের সুস্থ জীবন যাপনের জন্য সঠিক পরিচালনার প্রয়োজন।
প্রশ্ন-১: মায়ের asthma থাকলে কি শিশুরও এজমা হবে?
উত্তর: এজমায় ভুগছেন এমন যে কোনো মা এই আশংকা করে থাকেন। অনেক সময় জন্মের পর শিশুর শ্বাসকষ্টের জন্যেও মাকে দায়ী করা হয়ে থাকে তাই অনেকসময় গর্ভবতী মা এজমা বা শ্বাসকষ্টের কথা গোপনের চেষ্টাও করে থাকে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, শুধু মা নন পরিবারের যে কোন সদস্যের কাছ থেকেই শিশুর মধ্যে এজমা বংশগতভাবে পরিবাহিত হতে পারে। মায়ের বা পরিবারে অন্য কারো এজমা থাকলে শিশুর এজমা হবেই এ ধারণাও সঠিক নয়। এজমার ট্রিগার বা কারণসমূহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শিশুকে এজমা থেকে রক্ষা করা সম্ভব।
প্রশ্ন-২: মায়ের কোন বৈশিষ্ট্যের কারণে শিশুর এজমার সম্ভাবনা বেড়ে যায়?
উত্তর: গর্ভবতী মা এবং তার নিকটাত্মীয় কেউ (যেমন বাবা, চাচা) ধূমপায়ী হলে শিশুর এজমা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। তাই যে পরিবারে অন্তঃসত্ত্বা মা রয়েছেন সবারই অনাগত শিশুর স্বার্থে ধূমপান পরিহার করা অবশ্য কর্তব্য।
প্রশ্ন-৩: এজমা হওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস করার উপায় কী?
উত্তর: জন্মের পর অন্তত প্রথম ছয়মাস এবং পূর্ণ দুই বছর পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধ পান করালে শিশুর যে কোনো এলার্জিজনিত রোগের সম্ভাবনা কমে যায়, যার মধ্যে ফিভার,একজিমা এবং এজমা অন্যতম।
প্রশ্ন-৪: এজমার সাধারণ ট্রিগার (কারণ) কী কী?
উত্তর: ট্রিগার হল সেইসব কারণ যা এজমার সম্ভাবনা রয়েছে এমন রোগীর বায়ুপরিবাহী নালীর অতিসংবেদনশীলতা বা Hypersensitivity সৃষ্টি করে এবং ফলশ্রুতিতে এজমার লক্ষণ দেখা দেয়। এলার্জির কারণ যেমন এক একজনের ক্ষেত্রে এক এক রকম, তেমনি এজমার ট্রিগারও এক একজনের ক্ষেত্রে এক এক ধরণের হতে পারে। সাধারণত এজমার ট্রিগারগুলো হচ্ছে সর্দি বা ফ্লু, প্রত্যক্ষ বা শিশুদের ক্ষেত্রে পরোক্ষ ধূমপান, শিশুদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত দৌড়ঝাঁপ, বড়দের ক্ষেত্রে ব্যায়াম বা অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম (Exercised-induced asthma), ফুলের পরাগরেণু থেকে সৃষ্ট এলার্জি (যা শীতকালীন এজমার প্রধান কারণ), লোমশ বা পালকযুক্ত পশুপাখি বা খেলনাপুতুল (টেডিবিয়ার ইত্যাদি), ঘরের ময়লা ধূলাবালির কীট বা মাইট (Mite), শীতকালীন কুয়াশা, রাস্তার ধূলাবালি ইত্যাদি। ঠিক কোন বস্তুটি আপনার বা শিশুর জন্য ট্রিগার হিসেবে কাজ করছে, একবার সনাক্ত করতে পারলে আপনার জীবনযাত্রা অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে।
প্রশ্ন-৫: শুনেছি ইনহেলার বা নেবুলাইজার একবার নিলে বার বার নিতে হয়, এটা কি সত্য?
উত্তর: এজমা সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য কোনো রোগ নয়, এটি একটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগ। কাজেই ইনহেলার বা নেবুলাইজেশন আপনাকে পুনঃ পুনঃ ব্যবহার করতে হতেই পারে, কিন্তু তা ওষুধের উপর নির্ভরশীলতার জন্য নয় বরং রোগটির প্রকৃতির জন্য। ডায়াবেটিসের ইনসুলিন বা উচ্চ রক্তচাপের ওষুধের মত ইনহেলার বা নেবুলাইজেশনও আপনার নিয়মিত ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়তে পারে, কিন্তু তাতে ভয়ের কিছুই নেই কারণ এগুলোতে নির্ভরশীলতা সৃষ্টিকারী কোনো উপাদান ও নেই।
প্রশ্ন-৬: ইনহেলার বা নেবুলাইজেশনের পরিবর্তে মুখে খাওয়ার ওষুধ দিলে হয় না?
উত্তর: ইনহেলার বা নেবুলাইজেশনের প্রধান দুটি উপাদান স্টেরয়েড এবং ব্রংকোডাইলেটর (Bronchodilator)। এগুলো শ্বাসের সাথে ইনহেলার বা নেবুলাইজারের মাধ্যমে গ্রহণ করলে সরাসরি ফুসফুসে পৌঁছে গিয়ে দ্রুত কাজ করা শুরু করে, তাৎক্ষণিক শ্বাসকষ্ট কমায় এবং অনেক স্বল্প মাত্রার ওষুধ দিয়ে অনেক গুণ বেশি ফল লাভ করা সম্ভব হয়। কিন্তু সেই একই ফল মুখে খাওয়ার ওষুধ দ্বারা পেতে চাইলে অনেক বেশি মাত্রার ওষুধ খেতে হয়। মুখে খাওয়ার ট্যাবলেট বা সিরাপ শুধু ফুসফুস নয় বরং দেহের বাকি অংশ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়ে শোষিত হয়। যেহেতু এজমা নিরাময়যোগ্য কোনো রোগ নয় এবং এই রোগে আপনাকে দীর্ঘমেয়াদী ওষুধ সেবন করতে হবে তাই এই দীর্ঘ দিন ধরে নিয়মিত স্টেরয়েড ট্যাবলেট বা সিরাপ সেবনের ফলে বিভিন্ন গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে যার মধ্যে রয়েছে Cushing syndrome, ভংগুর হাড় বা অস্টিওপোরোসিস (osteoporosis বা ছিদ্রযুক্ত হাড়), ডায়াবেটিস, পেপটিক আলসার, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাসের ফলে বার বার ইনফেকশন ইত্যাদি। কিন্তু ইনহেলারে ব্যবহৃত স্টেরয়েডের মাত্রা অনেক কম থাকে এবং তা সরাসরি ফুসফুসে শোষিত হয়ে স্থানীয়ভাবে কাজ করে বলে এসব প্রাণঘাতী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আপনাকে বা শিশুকে আক্রান্ত করতে পারেনা। এছাড়া ইনহেলারের আরেকটি উপাদান ব্রংকোডাইলেটর যেমন স্যালবিউটামল যা মুখে খাওয়ার ওষুধে গ্রহণ করলে কাঙ্ক্ষিত ফল লাভের জন্য যে মাত্রায় দিতে হবে তা শুধু ফুসফুস নয় বরং হৃদযন্ত্রের উপরেও কাজ করে আপনার বা শিশুর বুক ধড়ফড় ও হৃদযন্ত্র সঞ্চালন হার বৃদ্ধি করতে পারে। কিন্তু ইনহেলার বা নেবুলাইজেশনে ব্যবহৃত স্যালবিউটামল শুধুমাত্র ফুসফুসীয় রিসেপ্টরসমূহের উপর স্থানীয়ভাবে (Locally) কাজ করে এবং অনেক স্বল্পমাত্রায় দেওয়া হয় বলে এ ধরণের কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়না।
প্রশ্ন-৭: শিশুর ইনহেলার নিয়মিত ব্যবহার করছি কিন্তু কোনো উন্নতি হচ্ছে না।
উত্তর: ব্যবহারের নিয়মটি সঠিক হচ্ছে কিনা, আপনার চিকিৎসকের সামনে ব্যবহার করে এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে নিন। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে শিশুর জন্য স্পেসার ব্যবহার করুন।
প্রশ্ন-৮: কীভাবে বুঝবেন এজমা অবনতির দিকে যাচ্ছে?
উত্তর: নিম্নলিখিত যে কোনো এক বা একাধিক লক্ষণ দেখা দিলে বুঝবেন যে আপনার চিকিৎসকের সাথে এখন দেখা করার প্রয়োজন- প্রথমত, অধিক পরিমাণ বা বার বার ইনহেলার সেবনের প্রয়োজন অনুভব করা। দ্বিতীয়ত, রাতে ঘুম থেকে কাশতে কাশতে বা শ্বাসকষ্ট বা বুকে চাপ অনুভব করে জেগে ওঠা। তৃতীয়ত, শিশুর স্বাভাবিক খেলাধুলা বা বড়দের স্বাভাবিক প্রাত্যহিক কাজকর্ম সম্পাদন করতে কষ্ট অনুভব করা
প্রশ্ন-৯: হঠাৎ এজমার আক্রমণ বা শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে করণীয় কী?
উত্তর: নিম্নলিখিত ধাপসমূহ অনুসরণ করুন- * উপশমকারী (Reliever) ইনহেলারের দুই পাফ নিন। * শিশুর টাইট জামাকাপড় ঢিলা করে দিয়ে তাকে সোজা করে তুলে বসান। * প্রতি এক মিনিট পর পর ইনহেলারের এক পাফ নিতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত অবস্থার উন্নতি না হয় (সর্বোচ্চ পাঁচ মিনিট) *যদি পাঁচ মিনিট পরও অবস্থার কোন লক্ষ্যণীয় উন্নতি না ঘটে তাহলে অতি দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান বা এ্যাম্বুলেন্স ডাকুন। * ডাক্তারের কাছে না পৌঁছানো পর্যন্ত বা এ্যাম্বুলেন্স এসে না পৌঁছানো পর্যন্ত প্রতি এক মিনিটে একবার করে উপশমকারী ইনহেলারের পাফ নিতে হবে। * আর যদি পূর্বে উল্লেখিত ধাপে পাঁচ মিনিটের মধ্যে অবস্থার উন্নতি ঘটে, তাহলেও পরবর্তী দুইদিনের মধ্যে চিকিৎসকের সাথে দেখা করে নিতে হবে।
লেখিকাঃ ডাঃ মৌলী আখন্দ, মেডিকেল অফিসার, নবজাতক ও শিশু নিবিড় পর্যবেক্ষণ ইউনিট, ইউনিভারসাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।