মানুষকে বিধাতা কষ্ট সইবার একটা সফটওয়্যার দিয়ে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। নিজের অজান্তেই মানুষ তা বহন করে চলেছে জন্ম-জন্মান্তর। আমিও অভ্যস্ত হয়ে গেলাম হাসপাতাল জীবনে। আমার জন্য কেবিন নেয়া হলো,অনির্দিষ্ট কালের জন্যে। প্রতিদিন চার হাজার টাকা। আমার সাথে যারা থাকছেন হাসপাতালে তাদেরও একটা খরচ আছে। মানুষতো, যত বিপদই আসুক পেটের ক্ষুধা নামক অনুভূতি থেকে কারো নিস্তার নেই। আমি ততদিনে বেশ হাসপাতালকে বাড়ি ভাবতে শুরু করেছি। দিনে চারবার মনিটরিং করতে যাই,বাচ্চার হার্টবিট শুনি, মুভমেন্ট গুনি। যেতে আসতে কত ডাক্তার-রোগীর সাথে সাময়িক সম্পর্ক হয়। সবাই যে একটা নদীতে পানাফুলের মত ভাসছি, ভাসতে ভাসতে কাছে আসছি আবার দূরে সরে যাচ্ছি। যারা বেশ চেনা ডাক্তার-নার্স-আয়া-ওয়ার্ডবয় হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে ভালো আছেন তো? সব ঠিক আছে তো? আমার সাথে হবু মা গুলো চলে যায়, নতুন করে আসে আবার, আমার আর ছুটি নেই। প্রতিদিনই নতুন মানুষের আনাগোনা,নতুন নতুন কষ্টের গল্পের মুখোমুখি হই। লিফটে যেদিন একা হয়ে যাই, নিরাপত্তাহীনতায় ভুগি, এই বুঝি লিফটে থাকা লোকগুলো ছোবল দেয়। আমি মা হবো, অথচ মানসিক শান্তি নিয়ে একা চলার কথা ভাবতে পারি না। আমার মনে পড়ে যায় "তনুর" কথা। মেয়েটার মুখটা ভেসে উঠে। যদিও কড়া গার্ড আছে, তবুও গা ছমছম করতো। আর ভাবতাম আমার সন্তানকে ইনশাআল্লাহ আমি শেখাবো নারীকে, মা জাতিকে সন্মান করতে।
দেখতে দেখতে আমার সিজারের দিন এগিয়ে আসলো। সুযোগ পেলেই বরের হাতটা ধরে বলি, আমি বোধহয় বাঁচবো না। আমার ধারণা সব মেয়েরাই বলে। ও বোঝায় রাতটা পেরুলেই বাবুকে দেখবা, সাহস রাখো। আমাকে রাতে কিছু খেতে দেয়া হলো না, ভয় হলো আমার ডায়েবেটিকস না নীল হয়ে যায়। আমি সারা রাত জেগেই কাটালাম,পেটের ভেতর বাবু টা লাথ্থি দেয়,আমার সাহস একটু বাড়ে। পেটের উপর হাত রেখে বলি "বাবাই সোনাটা,ভয় পেয়োনা আমি তোমায় জীবন দিয়ে হলেও আগলে রাখবো।" সকালে উঠেই গোসল করে বেণী করলাম। বেণী নিষ্প্রাণ কোমর অবধি পরে রইলো,এর যেনো আর সৌন্দর্য বাড়াবার দায়িত্ব শেষ। কানের দুল খুলে দিলাম, চুড়ি জোড়াও। আমি প্রতিজ্ঞা করলাম কাঁদবোনা যাবার সময়। পেছনে ফিরে এক নজরে সবাইকে দেখলাম। এগিয়ে গেলাম ওটির দিকে। খুব ইচ্ছে করলো আরেকবার তাকাই, যদি আর না ফিরি। আমাকে শুইয়ে দেয়া হলো। বললো, "আপু চশমাটা দিন। আমি বলি না দিবো না। আমি চশমা ছাড়া দেখতে পাইনা, আমার ছেলেকে দেখবো কি করে। বললো ঠিক আছে রাখুন। আমাকে এনেসথেশিয়া দেয়া হলো। দাঁত চেপে কষ্ট সইলাম। অনবরত দোয়া পরে যাচ্ছি বিড়বিড়িয়ে। একটাই চাওয়া বাচ্চাটা সুস্থ-সবল হোক। বাচ্চাটাকে কাছে যেনো পাই। আমি সহ্য করতে পারবো না বাবুকে ইনকিউবেটরে রাখতে হলে।
অপারেশনরত ডাক্তার, এসিস্ট্যান্ট, নার্সের সাথে কথা বলতে বলতে বাবু দুনিয়াতে আসার খবর পেলাম। ডাক্তার উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলছেন, এই যে আপনার ছেলে তো সালাম দিয়ে আসছে দুনিয়ায়। এতোটা সময় কাঁদিনি, যেই বাচ্চাকে দেখলাম,কপাল কুচিঁ করে তাকিয়েই আছে আমার কান্না কে দেখে! চশমাবতীর গ্লাসদুটো ঝাপসা হয়ে আসে। টপটপিয়ে পড়তে থাকে মুক্তোদানা আনন্দ অশ্রু। বাবুকে নিয়ে যায়। ওর স্বজনের কাছে তুলে দিতে। আমার খুব ইচ্ছে করছিলো কখন ওর বাবার মুখটা দেখবো, ও এই মুহূর্তে কেমন আছে? আমার মতোই কান্না করছে কি? ছেলেকে বুকে জড়িয়ে কেমন আছে সে? আমাকে পোস্ট-অপারেটিভ রুমে নেয়া হলো। সময়টা শুধুই প্রতীক্ষার, আবার কখন ছেলেটাকে দেখবো। যখন বাবু দ্বিতীয়বার কাছে আসলো, আমার কাছে খাবার খুঁজলো আমি তখন বিস্ময়ে স্থানু হয়ে গেলাম। কয়েক ঘন্টা যে দুনিয়াতে আসছে কি করে বুঝলো এভাবে খেতে হবে!!! আমি মনে মনে আমার সমস্ত অস্তিত্ব নিয়ে স্রষ্টার কাছে মাথা নত করলাম। আমি যেন ঘোরে আছি। সিজার হলো সকাল ১১টায়। আমি রাত ১২টায় বেডে আসার জন্য অস্থির হয়ে গেলাম। অনেক রিকোয়েস্ট করে রুমে আসলাম।
তখনও জানতাম না কি ভয়াবহতম মানসিক পরিস্থিতিতে আমি পড়তে যাচ্ছি। আমার সোনার মানিক, কলিজার টুকরো কিছুতেই খাবার পাচ্ছে না। শুধু চিৎকার করে কাঁদে। সে কান্না সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। কিছুতেই বাচ্চা আমার কাছেই আসে না। আমি তখন পাগলপ্রায়। আমি বাথরুমে গিয়ে কাঁদি, রাত তিনটায় বারান্দায় গিয়ে চাপা কান্নায় ভেঙ্গে পরি। শেষে বাচ্চার কষ্ট সইতে না পেরে লুকিয়ে পেপার পুড়িয়ে "ল্যাক্টোজেন ১" বানিয়ে খাওয়াই। পরদিনই আবার আরেক ঝড়ের মুখোমুখি হই। ব্লাড রিএকশন হয়। মনে মনে ভাবি আল্লাহ তুমি আমার যাই করো, বাচ্চাটাকে বাঁচিয়ে রেখো। আমি ৮০ বছরের বৃদ্ধার মত কাঁপতে থাকি ঠকঠকিয়ে। শরীরে প্রচন্ড জ্বর। ডাক্তারও ভয় পেয়ে যায়। বড় ম্যাডামকে ডেকে আনে। আমি প্রতিটা মুহূর্ত শুধু আল্লাহকে ডাকি আর বলি আমার স্বামী-সন্তানকে ভালো রেখো। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি আবার বেঁচে উঠি। খুশি মনে ব্যাগ গুছাতে থাকি, এতোদিন পর বাসায় যাবো। বিধিবাম, ডাক্তার বললো বাচ্চার জন্ডিস। ফোটোথেরাপি দিয়ে বাসায় ফিরলাম। বাসায় এসে গোসলের পর দেখি সারা শরীরে জল ঠোসার মত কিছু হয়েছে, গুটিগুটি। তখনই আবার ডাক্তার কাছে গেলাম। জানলাম আমার পক্স!!! বাচ্চাটাকে দূরে রাখতে হবে। মনকে শক্ত করলাম। ধৈর্য্য ধরে দূরে দূরে রইলাম। সে যে কি কষ্ট! বাচ্চা কাঁদে কাছে যেতে পারি না,বাচ্চা আমাকে খোঁজে কোলে নিতে পারি না। দূর থেকে দেখি। এরই নাম জীবন।
এরপর থেকে আমি প্রতিদিন নতুন কিছু শিখি কি করে বাচ্চাকে সবচেয়ে ভালো যত্নটা দেয়া যায়। আমি প্রতিদিনই একটু একটু করে "মা "হয়ে উঠি। আহনাফের মা।