গা ঝিমঝিম, ক্লান্তি ভাব, হাত-পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা, আর সারা শরীরে আজব একটা স্পর্শকাতর অনুভূতি!
কী এমন হলো, যে রাতারাতি এই সব হচ্ছে আপনার? শরীর-টরীর খারাপ হলো না তো!
আরে না, না! শরীর কেন খারাপ হবে। এ যে ‘তার’ আসার মিষ্টি আভাস! মা হতে চলেছেন আপনি।
খবরটার অপেক্ষায় হয়তো দিন রাত এক করেছেন এদ্দিন, কিন্তু শুধু একটু সচেতনতার অভাবে টেরই পাননি সেটা। যাক, দেরি হলেও জানতে পেরেছেন, তবে এবার শুরু সচেতনতা, সতর্কতা আর নিজের খেয়াল রাখার পালা। যেহেতু গর্ভস্থ সন্তানের এক্কেবারে শুরুর সময়, তাই মাকে থাকতে হবে অনেক বেশি তটস্থ। কিন্তু বললেই তো আর সতর্ক হওয়া যায় না! কারণ অনেক ক্ষেত্রেই মায়েরা বুঝতেই পারেন না যে কী হচ্ছে বা কী হতে পারে। অনেকেরই নিজের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে সঠিক ধারণাই থাকে না, জানা থাকে না কী করলে সন্তানের ভালো বা খারাপ হতে পারে। তাই গর্ভধারণের এই প্রথম পর্যায়টি (first trimester) অনেকের জন্যই ক্ষতির হতে পারে, যদি সঠিক যত্ন না হয়। তাই গর্ভধারণের প্রথম তিনটে মাস নিয়ে, মায়েদের শারীরিক অবস্থা্র সবকিছু নিয়েই আজকের এই আলোচনপ্রথমেই জেনে নিন আপনি প্রেগন্যান্ট কি না। আজকাল প্রেগন্যান্সি কিট কিনতে পাওয়া যায়। তা দিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। এসব কিট দিয়ে যে পরীক্ষা করা হয় তার মধ্যে প্রায় ৯৫ শতাংশ পরীক্ষাই সঠিক হয় বলে। তবে ১০০ শতাংশ নিশ্চিত হতে চাইলে ডাক্তারের পরামর্শে আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। নিশ্চিত যখন হওয়া গেল, এবার তবে জানা যাক পরবর্তী পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে।
গর্ভাবস্থায় প্রথম ৩ মাসের সতর্কতা (First trimester: your essential pregnancy to-do list)
- সাবধানে চলাফেরা করুন। অ্যালকোহল, ক্যাফেইন, ধূমপান থেকে দূরে থাকুন, তা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যেমনই হোক না কেন।
- যেহেতু আপনি অন্তঃসত্ত্বা, তাই আপনাকে সবসময় ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে। ভালো স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে তাই যোগাযোগ করুন এখনই।
- সন্তানধারণের ফলে শরীরে হরমোনঘটিত বেশ কিছু পরিবর্তন হয়। যার কারণে বমি-বমি ভাব, মাথা ঘোরা, খেতে না পারা, শরীর খারাপ ভাব হতেই পারে। এমন কিছু হলে ভয় পাবেন না, আবার না হলেও চিন্তা করবেন না। বেশি বমি হলে সকালে উঠে লেবু পানি খেয়ে নিন।
- এছাড়াও হরমোন ঘটিত পরিবর্তনের কারণে এ সময় স্তনের আকারও পরিবর্তন হওয়া শুরু হয় ধীরে ধীরে। সেই কারণে স্তনে ব্যথা হবে ও স্তন নরম হয়ে যাবে। মনে রাখবেন এই পরিবর্তন আপনার সন্তানের জন্যই জরুরি।
- সন্তান গর্ভে ধারণ করার ফলে কিছু শারীরিক পরিবর্তন হয়। যেহেতু সন্তান জরায়ুতে ধারণ করা হয় ও জরায়ুর অবস্থান থাকে প্রসাবের নালির ঠিক উপরে, তাই বাচ্চার বৃদ্ধির সাথে সাথে জরায়ু প্রসাবের নালির উপরে চাপ ফেলতে থাকে। এর ফলে প্রসাবের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া স্বাভাবিক. এছাড়াও অনেক অন্তঃসত্ত্বা মহিলারই রক্তচাপের সমস্যা দেখা দিতে পারে। কারও রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে, কারও আবার কমেও যেতে পারে। সেই সঙ্গে দেখা দিতে পারে ডায়াবেটিসের সমস্যা। এমন কোনও সমস্যা দেখা দিলে নিয়মিত চেকআপের মধ্যে থাকতে হবে।
- বুক জ্বালা এবং কোষ্ঠকাঠিন্যও হতে পারে অনেক মায়ের। অন্তঃসত্ত্বা নারীর খাবার হজম হতে ও পেট খালি হতে অন্য নারীদের তুলনায় বেশি সময় লাগে, কারণ গর্ভস্থ বাচ্চার পুষ্টি গ্রহণ করতে সময় লাগে একটু বেশি। আর এটাই গর্ভবতী নারীর জন্য হয়ে যায় মহা কষ্টের। ঘাবড়ে যাবেন না। দরকারে ডাক্তারের পরামর্শমতো ওষুধ খান।
- এরই সাথে আছে ‘মুড সুইং’-এর উৎপাত। শরীরে নানান হরমোনের নাচানাচি, ওঠানামায় ঘনঘন মেজাজ বদলাতেই পারে। হয়তো কখনও ভীষণ রাগ হতে পারে আপনার, কখনও বা প্রচণ্ড আনন্দ। একটুতেই হয়তো কেঁদে ফেললেন, কিংবা অল্প খুশিতেই ভীষণ হাসি। হাসি, খুশি থাকাটা না হয় ভালো, কিন্তু সন্তানের খাতিরে রাগ-রোষটা আপনাকেই সামলাতে হবে।
- ঘুমের সময় বাড়িয়ে দিন। দিনে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা করে ঘুমানোর চেষ্টা করুন। এছাড়াও সারাদিনের কাজের ফাঁকে ফাঁকে হালকা বিশ্রাম নিন।
- এই তিন মাসে যৌন সম্পর্ক করতে চাইলে করাই যায়। তবে সে ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।এত কিছু পরামর্শ দেওয়া এ কারণেই যে গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসেই কিন্তু গর্ভপাতের আশঙ্কা থাকে সবচেয়ে বেশি। এই সময়টা পেরিয়ে গেলেই সন্তান কোলে আসার পথে আর তেমন কোনও বাধাই থাকে না। এবার চলুন দেখে নেওয়া যাক গর্ভকালের প্রথম তিন মাস কী খাবেন, কী খাবেন না!
গর্ভবতীর প্রথম ৩ মাসের সতর্কতা ও খাদ্য (First Trimester Diet in Pregnancy – Foods to Eat & Avoid)
যাঁরা প্রথমবার মা হতে চলেছেন, গর্ভস্থ সন্তানের কথা ভেবে এসময় তাঁরা অজ্ঞানতায় বেশি বেশি খাবার খেয়ে ফেলেন, এবং ওজন বাড়িয়ে ফেলেন অনেকটা বেশি! পরে এরই জন্য অনেক ক্ষতি হয় মা এবং বাচ্চার। এখানে আমরা মোটামুটি একটা ছক বাতলে দিচ্ছি, দেখুন কাজে আসে কি
- রোজের সাধারণ খাবারের সাথে অতিরিক্ত ১ গ্লাস দুধ ও ২টি অতিরিক্ত রুটি খেতে পারেন। এছাড়া তাজা ফলমূল ও শাক সবজি খাবেন।
- প্রচুর পানি পান করুন। ৮ থেকে ১০ গ্লাস রোজ। ক্যাফেইন সমৃদ্ধ খাবার এড়িয়ে চলুন। কেননা এতে ঘুম কম হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিছু ড্রিংকস চাইলে ফলের জুস, দই, লস্যি এসব খান।
- যতটা সম্ভব বাইরের খাবার এড়িয়ে চলুন। বাড়ির টাটকা রান্না খান।
- এ সময় কিছু জিনিস অবশ্যই দরকার হয়, তার মাঝে একটি হল, ফোলেট বা ফলিক এসিড। রোজের ওষুধের পাশাপাশি সবজি থেকেও খানিক ফোলেট পেতে পারেন আপনি। খাবার তালিকায় রাখুন করলা, ক্যাপসিকাম, ব্রকলি, মেথি, পুদিনা, বাদাম, কিশমিশ ইত্যাদি।
- পেঁপে, আনারসের সাথে সাথে কাঁচা বা আধা সিদ্ধ প্রোটিন যেমন মাছ, মাংস, ডিম এসব এড়িয়ে চলতে হবে। প্রোটিন ভালো করে রান্না করে তবেই খাবেন।· সেই সাথে গলানো চিজ, মেয়োনিজ এসবও কদিন না খাওয়াই ভালো। প্রথম ৩ মাস খেতে কষ্ট হয়, কিছু খেতে ইচ্ছেও করে না। তাও বাচ্চার কথা চিন্তা করে যতটা সম্ভব ততটা স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন।
গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসে ভ্রূণের বৃদ্ধি (Growth of Your Baby in The First Trimester)
- গর্ভাবস্থার প্রথম মাসেই বাচ্চার হৃদপিণ্ড ও ফুসফুসের গঠন হওয়া শুরু হয়ে যায়। এই সময়েই শিশুর হাত, পা, মস্তিষ্ক, স্নায়ুরজ্জু এবং স্নায়ুর গঠন ও শুরু হয়ে যায়। ভ্রূণের আকার তখন হয় একটি মটর দানার মতন।
- দ্বিতীয় মাসে ভ্রূণের আকার বৃদ্ধি পেয়ে শিমের দানার মতো হয়। গোড়ালি, কব্জি, আঙুল ও চোখের পাতা তৈরি হয়। হাড়ের গঠন শুরু হওয়ার সাথে সাথে যৌনাঙ্গ এবং অন্তঃকর্ণ-এরও বিকাশ শুরু হয়।
- দ্বিতীয় মাসের শেষের দিকে ভ্রূণের ৮-১০টি প্রধান অঙ্গ গঠিত হয়। শিশু এতদিনে হাত-পা নাড়াতে শুরু করে দেয়, যদিও তার টের পাবেন না এখুনি।
- অভিনন্দন! প্রথম ট্রাইমেস্টারের শেষ মাইলস্টোনে পৌঁছেই গেছেন আপনি। গর্ভস্থ শিশু এতদিনে সাড়ে তিন ইঞ্চির হয়ে গেছে। ওর হাড় ও পেশীর বৃদ্ধিও তরতরিয়ে চলছে। ভবিষ্যৎ দাঁতের জন্য ভিত্তি তৈরি হচ্ছে। হাত ও পায়ের আঙুলের গঠনও চলছে পাশাপাশি। এই সময়ে অন্ত্রের গঠন শুরু হয় এবং ভ্রূণের ত্বক প্রায় স্বচ্ছগর্ভস্থ শিশুর বাড়-বৃদ্ধি নিয়ে মোটামুটি একটা ধারণা যখন হয়েই গেলো, এবার তবে নিজের শরীর নিয়েও একটু সতর্ক হয়ে যান।
আরও একবার ঝালিয়ে নিন, প্রথম তিন মাসে হবু মায়ের শারীরিক পরিবর্তনের খুঁটিনাটি।
প্রথম তিন মাসে মায়ের দেহে পরিবর্তন সমূহ (Mothers’ Physical Changes in the First Trimesterমেয়ে, বোন, বান্ধবী, প্রেমিকা, স্ত্রী, পুত্রবধূর মতো বিশেষণগুলি পেরিয়ে এবার সবচেয়ে প্রিয় ডাকটা শোনার পালা। মা! যার জন্য এত প্রতীক্ষা, সে যে সহজে, বিনা ঝঞ্ঝাটেই চলে আসবে, এ কথা ভাবা বোকামির সমান। গর্ভকালে পুঁচকেটার আগমনের প্রস্তুতি হিসেবে নানা পরিবর্তন হবে আপনার শরীরে। যার জেরে রীতিমতো কাহিল অবস্থাও হতে পারে আপনার! ঘাবড়ে যাবেন না, আপনাকে ফের একবার সচেতন করে দিতেই নীচের এই পয়েন্টগুলো লেখা…
· হরমোনের পরিমাণ, ধরন বদলে শরীরে নানা পরিবর্তন হবে। বাইরে থেকে এর আভাস না পেলেও ভিতর ভিতর টের পাবেন ভালোই।
· প্রেগনেন্সি হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধির ফলে বমিবমি ভাব ও বমির সমস্যা দেখা দিতে পারে। কারও কারও নির্দিষ্ট কোনও গন্ধের প্রতি সংবেদনশীলতা তৈরি হতে পারে!
· এছাড়াও দিনভর দুর্বল অনুভব করা, স্তন নরম হওয়া ও ফুলে যাওয়া, পেট খারাপ হওয়া, খাবারে অরুচি বা খুব বেশি খিদে পাওয়া, মেজাজের পরিবর্তন, কোষ্ঠকাঠিন্য, বুক জ্বালাপোড়া করা, ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, মাথাব্যথা ইত্যাদি তো র ডাক্তারের পরামর্শ মতো চললে, নিয়মিত চেকআপ করালে এসবের থেকে কিছুটা আরাম আপনি পেতেই পারেন।
গর্ভাবস্থার প্রথম তিনটে মাস নিয়ে আপনাদের যাবতীয় সংশয়ের সমাধান আশা করি হল।