সাধারন বিষয় গুলোঃ
✅ নির্দিষ্ট একটি উঁচু স্থান থেকে লাফ দিয়ে পড়ে না গিয়ে নিজ পায়ের উপরে দাঁড়াতে পারে।
✅ কোন কিছুর প্রতি ৮ থেকে ১০ মিনিটের জন্য মনোযোগ ধরে রাখতে পারে।
✅ বোতাম এবং চেইন খুলতে ও লাগাতে পারে।
✅ মিথ্যা বলার প্রবণতা দেখা যায়।
✅ বাস্তব এবং কল্পনার মধ্যে পার্থক্য বোঝা শুরু করে।
? উচ্চতাঃ ১০০.৫-১০১.৯ সে.মি
? ওজনঃ ১৫.৭-১৬.২ কেজি
মূল পরিবর্তনঃ
এই বয়সে আপনার সন্তানের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটতে পারে। তাই তার পুরানো কাপড় হঠাৎ করেই ছোট হয়ে যেতে পারে কিংবা পরিবর্তন করে এক সাইজের বড় কাপড় দেওয়া লাগতে পারে। সে এখন অনেকটাই মিশুক প্রবণ হয়ে ওঠে। লজ্জা কমতে থাকে এবং খেলার মাঠে নতুন নতুন বন্ধুদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। আপনার সন্তানকে যদি প্রি স্কুলে ইতিমধ্যে দিয়ে থাকেন তাহলে সে স্কুলের পরিবেশের সাথে অভ্যস্ত হয়ে যায়। সেখানে নতুন নতুন বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করা এবং শিক্ষকদের কাছ থেকে মজার মজার গল্প ও ছড়া শুনে সে অত্যন্ত আনন্দিত হয়।
দৈহিক পরিবর্তনঃ
আপনার সন্তান এখন ঘরের দরজার লক/হাতল ঘুরিয়ে দরজা খুলতে পারে। সে তার খাতায় বিভিন্ন আকারের ছবি, বড় হাতের কয়েকটি অক্ষর, এমনকি মানুষের আকৃতির ছবি আঁকতে পারে। আপনার শিশু একটি নির্দিষ্ট দিকে রং করে তার অংকন সম্পন্ন করে। সে এখন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বস্তুগুলিকে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়। সে একা একা বইয়ের একটি করে পৃষ্ঠা উল্টাতে পারে। এছাড়াও সে এখন সিঁড়ির হাতল না ধরেই সিঁড়িতে দুই ধাপে দুই পা দিয়ে উঠা নামা করতে পারে। সে এক পায়ের উপরে দাঁড়িয়ে ৫ সেকেন্ড সময় ধরে ব্যালেন্স রাখতে পারে কিংবা লাফাতে পারে। পা দিয়ে সামনে-পিছনে বল ছুড়ে মারতে পারে এবং উঁচু থেকে লাফ দিয়ে ব্যালেন্স রেখে পড়ে না গিয়ে পায়ের উপরে দাঁড়াতে পারে।
? চিন্তার বিষয়ঃ
? বল ছুড়ে মারতে, উঁচু থেকে লাফ দিতে কিংবা ট্রাই সাইকেল চালাতে গিয়ে আপনার সন্তান যদি অসুবিধা বোধ করে।
? সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে যদি অসুবিধা হয় এবং বারবার পড়ে যায়।
? সঠিকভাবে পেন্সিল ধরতে তার যদি সমস্যা হয় কিংবা কাগজে আঁকাআঁকি করতে না পারে।
? ছোট ছোট বস্তুগুলো যদি সে হ্যান্ডেল করতে না পারে।
বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবর্তনঃ
এই বয়সে আপনার সন্তান তার চারিদিকের ঘটতে থাকা ঘটনাগুলি অত্যন্ত নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণ করে। যে সারাদিন তার আশেপাশে থাকা মানুষদেরকে প্রচুর প্রশ্ন করে। সে এখন কোন কাজের প্রতি ৮ থেকে ১০ মিনিট পর্যন্ত মনোযোগ ধরে রাখতে পারে। এছাড়াও সে গণনার মাধ্যমে কোন কিছু পরিমাপ করতে শিখে এবং সময় সম্পর্কে ধারণা লাভ করে। সে ভিন্ন ভিন্ন জিনিস এবং ছবির মধ্যে পার্থক্য করতে শিখে। আবার এই বয়সে তার মধ্যে যে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনটি হয় তাহলো সে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার জন্য মিথ্যা কথা বলতে শিখে। বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলতে পারে আবার তার কল্পনার জগতে একা একা খেলতে পারে। আপনার সন্তান এখন তার বয়স উপযোগী পাজল মেলাতে সক্ষম হয়।
? চিন্তার বিষয়ঃ
? যদি আপনার সন্তান এখনো সাধারন নির্দেশনা মেনে কাজ করতে না পারে।
? সে যদি সাধারন গণনা কিংবা কমন বিষয়গুলি আয়ত্ত করতে না পারে।
? জামা কাপড় পরা, ঘুমানো কিংবা বিশ্রাম নেওয়ার সময় যদি সে সব সময়ই বিরক্ত করে।
মানসিক এবং আচরণগত পরিবর্তনঃ
আপনার সন্তান এখন তার আবেগগুলোকে আরো স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে পারে। আগে যেমন অল্পতেই সে বিরক্ত হয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করত এই বয়সে এসে তা কিছুটা কমে যায়। অর্থাৎ সে নিজের আবেগের ওপর যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ করতে শিখে। সে তার বিভিন্ন আবেগীয় অনুভূতিগুলো প্রকাশ করার জন্য মুখের এক্সপ্রেশন বদলাতে পারে। রাগ, হাসিখুশি , কান্না কিংবা বিরক্ত হলে সে সেই অনুযায়ী তার মুখের এক্সপ্রেশন দেখায়। সে তার পরিবারের সদস্যদের প্রতি এবং তার খেলার সাথীদের প্রতি স্নেহ এবং মায়া-মমতা প্রদর্শন করে থাকে। এছাড়াও সে তার আশপাশে থাকা মানুষদের সাথে যথেষ্ট বন্ধুত্বপরায়ন আচরণ করে। আপনার সন্তান এই বয়সে পালাক্রমে খেলার গুরুত্ব অনুধাবন করে।
? চিন্তার বিষয়ঃ
? যদি আপনার সন্তান এখনও নতুন জায়গায় এবং নতুন মানুষ দেখে ভয় পায়।
? যদি সে তার আবেগের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে না শেখে এবং অল্পতেই রাগান্বিত হয়ে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে।
? সে যদি এখনও তার কল্পনার জগতে খেলাধুলা না করে।
? অন্য বাচ্চারা যখন একসাথে খেলে তখন যদি সে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে।
ভাষাগত পরিবর্তন ও উন্নতিঃ
আপনার সন্তান এখন সাধারণ প্রশ্ন করতে পারে এবং আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। সে ৫০০ টি কিংবা তারও অধিক শব্দ স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করতে পারে এবং প্রায় ৬টি শব্দ জোড়া লাগিয়ে বাক্য তৈরি করে এবং একটির পর আরেকটি বাক্য বলে আলোচনা চালিয়ে যেতে পারে। সাধারণ কিছু প্রশ্ন যেমন তার নাম, বয়স, ভাই বোনের নাম ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। আপনার দেওয়া সাধারণ নির্দেশনা মেনে সে কাজ করতে পারে।
খাবার এবং পুষ্টিঃ
৪৭ মাসের শিশুরা বড়দের সব খাবার খেতে পারবে। তাকে দিনে চার-পাঁচবার খাওয়াতে হবে। এ সময় খাদ্যে ক্যালরির দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। এই বয়সে শিশুর খাদ্যে ১৫৭০ কিলোক্যালরি থাকা জরুরি।
সকাল ৭টা : ডিম, রুটি, ভাজি, হালুয়া, খিচুড়ি বা ডাল-রুটি। শেষে দুধ ও ফলমূল।
দুপুর ১২টা : ভাত, মাছ, গোশত, ডাল, শাকসবজি। শেষে খেতে চাইলে দুধ।
বিকেল ৫টা : সকাল ৭টার মতো।
রাত ৯-১০টা : দুপুর ১২টার মতো।
দিনে পাঁচবার খাওয়াতে চাইলে সকাল ৭টায় নাশতা দেওয়ার পর সকাল ১০টায় আবার নাশতা দেবেন। তারপর দুপুরের খাবার দেবেন ১টা থেকে দেড়টার মধ্যে।আবার বিকেল ৫টায় নাশতা দিয়ে রাত ৮টার মধ্যে রাতের খাবার শেষ করবেন। চাইলে ঘুমের আগে হাল্কা কিছু দিতে পারেন আবার না দিলেও চলে। এছাড়া শিশুকে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করাতে হবে।
যেসব বিষয়ে সাবধান থাকতে হবেঃ
আপনার সন্তানের উপর সব সময় নজর রাখুন। ঘরের ব্যবহার্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস যেমন ছুরি, চাকু, কাঁচি, ম্যাচ বক্স কিংবা বড়দের ঔষধ বাচ্চাদের নাগালের বাহিরে রাখুন। ক্রাফটিং করার সময় গ্লুউ গান এবং কাঁচির ব্যবহার থাকলে আপনি সাথে থেকে সেগুলি করতে সাহায্য করুন। যেহেতু সে এখন অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে খেলাধুলা করে এবং অনেক সময় স্ক্রিন টাইম পার করে এ কারণে তার আচরণে কোনো পরিবর্তন হচ্ছে কিনা তা লক্ষ্য রাখুন। তার মধ্যে নেগেটিভ কোন কিছু লক্ষ্য করলে অবশ্যই তাকে নিরুৎসাহিত করুন সে কাজটি করার জন্য। সে এখনো নিজের নিজের সবকিছু করতে যায় বিধায় খেয়াল করুন যেন সে কোন কাজে দুর্ঘটনায় না পড়ে।আপনার ছোট্ট সোনামণিকে বাহিরের নিয়ে গেলে সব সময় তার উপরে নজর রাখুন। এই বয়সেও শিশুরা পড়ে গিয়ে কিংবা দরজা, জানালা, ড্রয়ারের সাথে হাতে বা পায়ে আঘাত পেয়ে ব্যথা পেতে পারে। যেহেতু সে এখন সব ধরনের কাজ নিজে নিজে করতে চায় তাই তাকে সাহায্য করার কথা বলে তার সাথেই থাকুন এবং তার দিকে নজর রাখুন।অভিভাবক হিসাবে আপনার উচিত হবে শিশুকে বাইরের কারোর কোলে না দেওয়া। এমনকি শুধুমাত্র বাবা-মা ব্যতীত অন্য কেউ যেন তাকে চুমু না দেয়। শিশু যেতে চায় না এমন কারোর কাছে জোর করে কখনোই তাকে পাঠাবেন না। শিশুকে এখন থেকেই ভালো এবং খারাপ স্পর্শ সম্বন্ধে টুকটাক ধারণা দিন। পরিবারের সদস্য ব্যতীত অন্য কারোর সাথে বাইরে খেলতে পাঠাবেন না। যখন তাকে বাইরে খেলতে নিয়ে যাবে তখন অবশ্যই তার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাকে অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। এই বয়স থেকেই তার কাজ কর্মের প্রতি কিছুটা বাঁধ টানুন। তাকে কোন কোন কাজের ক্ষেত্রে নিষেধ করুন এবং তার ধৈর্য বৃদ্ধির জন্য সাথে সাথে কোন কিছু না দিয়ে তাকে কিছুটা অপেক্ষা করিয়ে তার আবদার পূরণ করুন। এতে করে শিশুর মধ্যে স্বেচ্ছাচারিতার প্রবণতা থাকলে তা কমতে শুরু করবে।
অভিভাবকদের জন্য টিপসঃ
আপনার ছোট্ট সোনামণিকে সারাদিন প্রচুর অ্যাক্টিভিটির মধ্যে ব্যস্ত রাখুন।তাকে ঘরে কিংবা বাইরে বিভিন্ন গোলকধাঁধা তৈরি করে দিন এবং সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করতে বলুন। তাকে তার বয়স এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ পাজল এনে দিন। নিয়মিত তাকে বাহিরে খেলতে নিয়ে যান এবং আপনিও তার সাথে খেলাধুলায় নিযুক্ত হন। তাকে প্রকৃতির কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিন। ঘরের ভিতরে খেলার জন্য তাকে এমন সব খেলনা দিন যেগুলি দিয়ে খেলতে কিছুটা মাথা খাটানোর প্রয়োজন হয়। তাকে নিয়ে লুকোচুরি খেলতে পারেন যা তার মানসিক বিকাশের জন্য খুবই উপকারী। এছাড়া তাঁর খেলনার মধ্যে স্যান্ডবক্স যুক্ত করতে পারেন কিংবা একটি ছোট পুল তৈরি করে দিতে পারেন। তাকে চক ও বোর্ড এনে দিন এবং প্রতিদিনের সেগুলোর মধ্যে কিছু না কিছু আঁকতে উৎসাহ দিন। খেলার ছলে তাকে পাজল, সংখ্যা এবং অক্ষর মিলানোতে সাহায্য করুন। যখনই সম্ভব হবে তার সামনে কোন কিছু জোরে জোরে গণনা করুন যেন সে গুনতে শিখে। এছাড়াও তাকে নিয়মিত বই পড়ে শোনান এবং এমন সব বই এনে দিন যার গল্পগুলো সাধারণ কিন্তু রঙিন এবং বড় বড় ছবিতে পরিপূর্ণ। তাকে সাধারণ নির্দেশনা গুলো মেনে চলায় অভ্যস্ত করুন। নতুন নতুন বন্ধু তৈরি তাকে উৎসাহ দান করুন। এইসময় প্রি-স্কুলে যাওয়ার উপযুক্ত বয়স। প্রি-স্কুলে দেওয়ার আগে যদি সম্ভব হয় তাহলে যেসব বাচ্চারা অলরেডি স্কুলে যায় তাদের সাথে আপনার সন্তানের পরিচয় করিয়ে দিন। এতে করে তাদেরকে দেখে স্কুলে যাওয়ার জন্য আপনার সন্তানের মধ্যেও আগ্রহ তৈরি হবে। তবে প্রি-স্কুল এ দেওয়ার আগে তার সাথে এই বিষয়ে কথা বলা জরুরী। আপনি আপনার সন্তানকে বোঝাতে পারেন যে স্কুল একটি মজার জায়গা এবং সেখানে গেলে অনেক মজার মজার খেলনা এবং বন্ধু পাবে। কিছু সময়ের জন্য মায়ের থেকে আলাদা থাকতে হবে কিন্তু এই সময়ে তুমি আরো অনেক মজা করতে পারবে। এভাবে আস্তে আস্তে তাকে মানসিকভাবে অভ্যস্ত করে তুলুন যেন তার মধ্যে অতিরিক্ত ভয় থাকলে তা দূর হয়ে যায়।