মনে করুন তো শেষ কবে আপনার শিশুকে একটি গল্প শুনিয়েছেন? আপনি নিজে যখন ছোট ছিলেন তখন হয়তো দাদা-দাদি অথবা নানা-নানির কাছে শুনেছেন অনেক গল্প। সেগুলোর অনেককিছু এখনও মনে আছে আপনার; হঠাত কখনও কোন সিনেমা দেখতে গিয়ে বা গল্প পড়তে গিয়ে ছোটবেলার কোন গল্পের সাথে মিল দেখে মনে মনে হেসেছেন। আপনার শিশুদের এখন সেই সৌভাগ্য হওয়ার সুযোগ অনেক কম। কিন্তু এজন্য আপনার শিশু কি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তা কি আপনি জানেন? অভিভাবকরা এখন শিশুদের তার প্রিয় কার্টুনটি স্মার্টফোনে বা টিভিতে দেখিয়ে ঘুম পাড়াতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। বিছানার পাশে শুয়ে বা বসে তাকে ৫-১০ মিনিটের একটি গল্পের বই পড়ে শুনানোর সময় কোথায়? বাসায় গল্পের বই নেই? নিজের ছোটবেলায় দাদা-দাদির কাছে শুনা কোন গল্পই বলুন না। অথবা নিজের স্মার্টফোন থেকে নামিয়ে নিন কিছু গল্প। আপনার শিশুর বয়স যদি ৩-১০ বছর হয়, এই গল্প পড়ে শুনানোর অভ্যাস বা নিজে নিজে গল্পের বই পড়ার অভ্যাস তাকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে সেটি তবে শুনুন। আপনার দাদা-দাদি বা অন্য যে কেউ যিনি আপনাকে ছোটবেলা গল্প শুনিয়েছে তারা আপনার জীবনে কি উপকার করেছে সেটিও তবে জেনে নিন।
শিশুদের গল্প শুনানোর ১০টি উপকারিতা
১। শিশুদের মধ্যে সৎগুণের বিকাশ ঘটায পৃথিবীর সব শিশুই গল্প শুনতে ভালোবাসে। তারা তাদের প্রিয় চরিত্রকে প্রায়ই নকল করতে চায়। যেসব গল্পের শেষে একটি অর্থপূর্ণ মেসেজ থাকে সেগুলো আপনার শিশুর মধ্যে সততা, ন্যায়পরায়ণতা, সৎসাহস, বুদ্ধি বিকাশে সহায়তা করে। আপনার চরিত্র গঠনে আপনার পরিবার, পারিপার্শ্বিকতা ইত্যাদি ছাড়াও আপনি ছোটবেলা থেকে যেসব বই পড়েছেন বা গল্প শুনেছেন তাদের প্রভাবও কিন্তু কম না। আপনি নিজেও সেটা জানেন না।
২। নিজের সংস্কৃতি এবং মূল সম্পর্কে ধারণা দেয গত ২০-৩০ বছরে আমাদের দেশ, আমাদের সমাজ এবং সংস্কৃতি কত বদলে গেছে। আপনার নিজের ছোটবেলার গল্প আপনার শিশুকে বলুন অথবা আপনার বাবা-মার সময়ের গল্প। কুলা, ঢেঁকি, পালকি কি জিনিস সেটা কি জানে আপনার শিশু? শীতের পিঠা, নবান্ন উৎসব আর গ্রামীণ মেলার সেইসব আনন্দময় স্মৃতিগুলো থেকে কেন বঞ্চিত করবেন আপনার শিশুকে? ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’ – ভেবে কষ্ট না পেয়ে সেই দিনগুলোর কথা আপনার শিশুর সাথে শেয়ার করুন। এতে করে তার নিজের সংস্কৃতি, নিজের সমাজ এবং মূল সম্পর্কে শক্ত ধারণা হবে। অনেক অভিভাবকদের কষ্ট যে তাদের সন্তানরা বিদেশ যেয়ে নিজ সংস্কৃতি ভুলে বিদেশি স্টাইলে চলা শুরু করেছে। সেই কষ্ট যদি সহ্য না করতে পারেন বা চান তবে সন্তানদের মধ্যে নিজের সংস্কৃতি সম্পর্কে ভালো ধারণা দিন।
৩। শিশুদের মধ্যে ভাষার দক্ষতা বাড় আপনার শিশু স্কুলে ভালো করুক এটা চান তো নাকি? তাহলে ২-৩ বছর বয়স থেকেই তাকে গল্প পড়ে শুনান। নতুন নতুন শব্দ এবং তাদের উচ্চারণ শিখে ফেলবে দ্রুত। স্কুলে ভর্তি করিয়ে প্রথম বছরই দেখবেন আপনার শিশু অনেকের চেয়ে এগিয়ে। আর একটা কথা, গল্প পড়ে শুনানোর দায়িত্ব কিন্তু খালি মায়ের না, বাবারও। গবেষণায় দেখা গেছে যেসব শিশুরা বাবা এবং মা দুজনের কাছেই গল্প শুনে তারা বেশি শব্দ শিখে এবং ভাষার উপর দখল ভালো হয় যারা কেবল বাবা অথবা মায়ের থেকে গল্প শুনে। কারণ বাবারা (পুরুষরা) যখন গল্প শুনান তখন মায়েদের (মেয়েদের) থেকে ভিন্ন ধরণের শব্দ এবং বাক্য ব্যাবহার করেন। ব্যাপারটি বেশ মজার, তাই না?
৪। শিশুদের মধ্যে শোনার দক্ষতা বাড় শিশুরা সাধারণত খুব কম সময় মনোযোগ ধরে রাখতে পারে। তারা কোনকিছু শোনার চেয়ে বলতেই বেশি ভালোবাসে। কিন্তু যখন শিশুদের আপনি গল্প পড়ে শুনাবেন তখন আস্তে আস্তে তার মধ্যে আগ্রহ নিয়ে শোনার এবং শুনে বোঝার চেষ্টা বাড়বে আর একই সাথে তার মধ্যে মনোযোগ দেয়ার প্রবণতা বাড়বে। তাই শিশুকে যদি মনোযোগী করতে চান এখন থেকেই একটি করে গল্প পড়ে শুনান। বাচ্চা কথা শুনে না, অনেক দুষ্টু, হাইপার একটিভ, কোন কিছুতে মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না – এইসব কমন সমস্যাগুলো যদি এড়াতে চান বা কমাতে চান এখন থেকেই গল্পের বই পড়ে শুনান আর আস্তে আস্তে বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করুন আপনার শিশুর মধ্যে।
৫। ক্রিয়েটিভিটি এবং কল্পনাশক্তি বাড় এটি আপনিও জানেন, আমরাও জানি। আপনি হয়তো ভাবতে পারেন, এইসব কল্পনাশক্তি আর ক্রিয়েটিভিটি দিয়ে কি হবে? আমার সন্তান তো আর লেখক বা আর্টিস্ট হবে না। আচ্ছা, না বানালেন আর্টিস্ট, লেখক, অভিনেতা… ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চান তো অন্তত? এখন যেসব শিশু প্রাইমারি স্কুলে পড়ছে তাদের মধ্যে ৮০% এমন একটি চাকরিতে ঢুকবে যেটি এখনও দুনিয়াতে আবির্ভূতই হয় নাই। ভবিষ্যতের সেইসব অজানা চাকরিতে ঢুকতে হলে যেসব স্কিল দরকার তার মধ্যে এক নাম্বারে হল ক্রিয়েটিভিটি। আর ভালো কথা, যদি মনে করেন যে এনিমেশন বা কার্টুনও তো বাচ্চার কল্পনাশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে – তাহলে ১০০% ভুল ভাবছেন। শিশুদের কল্পনাশক্তি বাড়ানোর জন্য গল্পের বইয়ের চেয়ে ভালো জিনিস আজ পর্যন্ত মানবজাতি আবিষ্কার করে নাই।