গর্ভাবস্থার শেষ ধাপটায় পৌঁছে গেছেন আপনি, প্রেগন্যান্সি গ্লো-তে রীতিমতো চকচক করছে আপনার চোখ, মুখ। মা হওয়ার অনুভূতি সবসময় আনন্দে রাখছে আপনাকে। পরিজনদের যত্নআত্তি, সঙ্গীর ভালোবাসা আর মনভরা উত্তেজনা নিয়ে দিন গুণছেন ডেলিভারির। চিন্তা শুধু একটা বিষয় নিয়েই! নরমাল ডেলিভারি হবে তো? নাকি শত আপত্তি সত্ত্বেও সেই কাটাছেঁড়ার মধ্যে দিয়েই যেতে হবে?
এই অবস্থায় এত চিন্তা করবেন না প্লিজ! বড়সড় কোনও জটিলতা যদি বাসা না বাঁধে তা হলে সাধারণ কিছু টিপস মেনে চললেই স্বাভাবিক ভাবে সন্তানের জন্ম দিতে পারবেন আপনি।
এই যে চারদিকে সিজারিয়ান-সেকশনের এত ছড়াছড়ি এর আসলে কোনও দরকারই কিন্তু নেই। আশ্চর্য হবেন একটা তথ্য় শুনলে! গবেষণা বলছে গর্ভবতী মহিলাদের ৮৫ শতাংশই সাধারণ প্রসব অর্থাৎ নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমে সন্তান প্রসবে সক্ষম। পড়ে থাকা ১৫ শতাংশের অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন পড়লেও পড়তে পারে। কিন্তু হিসেব বলছে, প্রতি তিন জন গর্ভবতী মহিলার ভিতর একজনের সি-সেকশন হচ্ছে ইদানীং।
কারণটা কী?
কারণ হল এই যে মূলত প্রসবের যন্ত্রণা এড়াতেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে নরমাল ছেড়ে সিজারের পথ বেছে নেন গর্ভবতীরা। এতে কিন্তু আখেরে ক্ষতিই। পরবর্তীতে অন্য কোনও জটিলতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায় অনেকটা। আর পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতেও বেশ দেরি হয়। তাই বলছি, নরমাল ডেলিভারিরই পথে হাঁটার যে সিদ্ধান্তটি আপনি নিয়েছেন, তা একবারে ঠিক। আসুন দেখে নিই নরমাল ডেলিভারির ইতিবৃত্তান্ত!
সাধারণ প্রসব কী?
জানি, বিষয়টা সক্কলেরই বেশ ভালো মতোই জানা। তা-ও বলি, এ হল সন্তান প্রসবের সবচেয়ে সহজ উপায়! মানে যোনিপথে সন্তানের স্বাভাবিক জন্ম। বিষয়টা শুনলে যত ভয়ের লাগে, আদপে তা নয়। খুব কোনও জটিলতা না থাকলে এখানে ওষুধপত্তরের কোনও বালাই থাকে না। প্রসব যন্ত্রণা থেকেও যদি মুক্তি পেতে চান, তারও উপায় আছে। সেটা অবিশ্যি সম্পূর্ণ আপনার সিদ্ধান্ত। ঠিক কোন অবস্থানে থাকলে সন্তান প্রসবের প্রক্রিয়া মায়ের কাছে কিছুটা সহজ হয়ে যাবে, সেটাই এখানে মূল বিবেচ্য। লেবার প্রসেস থেকে শুরু করে ডেলিভারি পর্যন্ত-পুরো বিষয়টাই হাতে থাকে মায়ের। যে কোনও জরুরি অবস্থার জন্য পাশে চিকিৎসক, নার্সরা তো থাকছেনই। এভাবে প্রসবের ফলে নবজাতক থাকে সুস্থ-সবল, চনমনে। মা-ও সুস্থ হয়ে ওঠেন অনেক তাড়াতাড়ি।
সাধারণ প্রসবের বিভিন্ন ধাপ
রুপালি পর্দায় যেমন দেখায়, সাধারণ প্রসবের প্রক্রিয়াটা কিন্তু এক্কেবারেই তেমন নয়। আপনি ভাবতেই পারেন, হঠাৎ করে প্রচণ্ড প্রসব বেদনা শুরু হলো আপনার, কাটা মাছের মতো ছটফট করতে করতে হাসপাতালে হাজির হলেন, তার কিছুক্ষণ পরই ট্যাঁ করে কেঁদে উঠল আপনার ছানা! বাস্তবটা কিন্তু এমন নয়। মোটামুটি তিনটি ধাপে শেষ হয় গোটা প্রক্রিয়াটা। যার ফলে একটু সচেতন থাকলেই আপনি বুঝে যেতে পারেন, সময় হয়ে এসেছে এবার! দেখে নিন সাধারণ প্রসবের তিনটি ধাপ!
#1. প্রসব যন্ত্রণা এবং নমনীয় জরায়ু মুখ
নরমাল ডেলিভারির প্রথম ধাপই এটা। ধীরে ধীরে প্রসব যন্ত্রণা শুরু হবে আপনার। আর নরম, পাতলা এবং স্ট্রেচেবল হবে জরায়ু মুখ/ সার্ভিক্স, যাতে সহজেই সেই পথে বেরিয়ে আসতে পারে গর্ভস্থ শিশু! যদি প্রথমবার মা হন তবে এই অবস্থায় প্রায় ১৩ ঘণ্টা কাটাতে হতে পারে আপনাকে। দ্বিতীয় সন্তানের ক্ষেত্রে সময়টা কমে ৭-৮ ঘণ্টা হয়ে যায়। পুরো সময়জুড়ে শরীরের এই অংশে লাগাতার সংকোচন-প্রসারণে পুরোপুরি খুলে যায় জরায়ু মুখ। অভিনন্দন! পুঁচকেটা এবার আপনার কোলে এলো বলে!
#2. প্রসবের চেষ্টা শুরু এবং শিশুর জন্ম
জরায়ু মুখ পুরোপুরি খুলে গেলেই শুরু হয়ে যায় প্রসবের দ্বিতীয় ধাপ। সংকোচন-প্রসারণের হার অনেকটাই বেড়ে যায় এ সময়ে। কিছু সময় পর পর হঠাৎ হঠাৎ মাথা চাড়া দেয় প্রচণ্ড প্রসব যন্ত্রণা। ঘনঘন এই সংকোচন-প্রসারণই গর্ভস্থ শিশুকে ধীরে ধীরে যোনিপথের দিকে নামতে সাহায্য করে। প্রত্য়েকবার সংকোচন-প্রসারণের সাথেই চিকিৎসক আপনাকে বলবেন, গর্ভস্থ শিশুকে নীচের দিকে ঠেলতে। আর অনুভূতিটা ঠিক কী রকম বলুন তো? কোষ্ঠকাঠিন্য হলে পটি করার সময় ঠিক যেমনটা প্রেসার হয়, সেটারই প্রায় শয়গুণ!
এই সময়টা মায়ের মেজাজ খুবই খিটখিটে হয়ে থাকে। হয় সবচেয়ে কাছের মানুষটির সাথে সেঁটে থাকতে চাইবেন তিনি নতুবা এক্কেবারে একলা। খুবই ক্লান্ত লাগবে মায়ের, সাথে বমি বমি ভাব।
এরই সাথে লাফিয়ে বাড়তে থাকবে প্রসব যন্ত্রণা। যোনির আশপাশে খুবই ব্যথা অনুভব করবেন আপনি। কেন না পুঁচকেটা তো এখন যোনিপথ দিয়ে নিজের মাথা বের করে দেওয়ার চেষ্টা করবে! যদি যোনিপথ যথেষ্ট প্রশস্ত না হয় চিকিৎসক তখন ওই জায়গাটা একটু কেটে দিতে পারেন (episiotomy)। ভয় পাবেন না, প্রসব প্রক্রিয়া সহজ করতেই এই পদক্ষেপ।
এরপরই ধীরে ধীরে দেখা দেবে মাথা, তারপর ছোট্ট হাতজোড়া, তারপর পেটু, পা, পায়ের পাতা! মায়ের পেটের নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছেড়ে ভূমিষ্ঠ হবে ছোট্ট শিশু।
#3. নাড়ি, অর্থাৎ গর্ভফুলের প্রসব
শিশুর জন্ম হলো মানোই যে মায়ের যন্ত্রণামুক্তি, এমনটা ভেবে নেওয়ার কারণ নেই। পুঁচকের পিছু নেবে গর্ভফুল বা নাড়ি। প্রসবের শেষ এই ধাপটাকে আফটার-বার্থ (afterbirth) বলে। কয়েক মিনিট থেকে আধা ঘণ্টা অবধি সময় লাগতে পারে গর্ভফুলের প্রসবে। আপনার চিকিৎসক এসময় হয়তো বুকের মধ্যে আগলে ধরতে বলবেন নবজাতককে, কিংবা আপনার তলপেটে হালকা মালিশ দেবেন। আর কিছুই নয়, নাড়ি কাটার প্রক্রিয়াটাকে একটু সহজ করতেই এসব কেরামতি।
ধকল অনেকটাই বুঝি, তাও জন্মের পর পরই বাচ্চাকে একবারটি দুধ খাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করুন। এতে লাভ আপনারই। স্তন্যপান করানোয় রক্তক্ষরণ কমে যায় অনেকটাই।
নরমাল ডেলিভারির খুঁটিনাটি
সব কিছু জেনে-শুনে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকার ইচ্ছেটা বুঝি আরও একগজ বেড়ে গিয়েছে? তা হলে বলব, প্রস্তুতি নিতে শুরু করুন এখনই। গর্ভাবস্থার শুরু থেকেই মেনে চলুন এই টিপসগুলি:
ডায়েট (Diet): প্রেগন্যান্সি নিশ্চিত হওয়ার পর থেকেই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ডায়েট মেনে চলুন। স্বাস্থ্যকর খাবার, টাটকা ফল ও শাক-সবজি প্রচুর পরিমাণে খান। সেই সঙ্গেই জোর দিন আয়রন, ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবারের উপর। নিয়মিত মাল্টিভিটামিন খান। শরীরের পেশি যত শিথিল থাকবে, ততই সম্ভাবনা বাড়বে নরমাল ডেলিভারির।
অ্যাকটিভ লাইফস্টাইল (Active Lifestyle): উঁহু, গর্ভাবস্থা কিন্তু কোনও অসুখ নয়। সন্তানধারণ করেছেন বলে গোটা সময়টাই শুয়ে-বসে কাটিয়ে দেবেন, এমন কিন্তু নয়। যদি না ডাক্তার তেমনটাই বলে থাকেন, অথবা আপনার কোনও জটিলতা না থাকে তা হলে হালকা কাজকর্ম সবই করুন। হাঁটুন, হালকা যোগব্যায়াম করুন। এতে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকবে, শরীর সুস্থ থাকবে, নরমাল ডেলিভারির সম্ভাবনাও বাড়বে। তবে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে।
পানি (Water): শরীরে ফ্লুইড চলাচল স্বাভাবিক রাখতে জলই এক-ও একমাত্র উপায়। এতে রক্ত চলাচল ভালো হয়, কনস্টিপেশনের সমস্যাও তৈরি হয় না। কাজেই পানি বেশি খেলে ডেলিভারির প্রক্রিয়া অনেক সহজ হবে। গর্ভাবস্থায় প্রতি দিন ৮ থেকে ১০ গ্লাস পানি খান।
মানসিক চাপ (Stress): শরীর সুস্থ, ঝরঝরে থাকলে তবেই সম্ভবনা বাড়ে নরমাল ডেলিভারির। আপনি যদি অহেতুক চিন্তা করেন, উদ্বিগ্ন থাকেন তা হলে শরীরটাই বিগড়ে যাবে। তাই বলছি, যত পারেন খুশি-খুশি থাকুন। প্রয়োজনে মনোবিদের সাহায্য নিন। প্রেগন্যান্সি মাসাজ নিলেও স্ট্রেস কমতে পারে।
এত অবধি পড়ে আপনার মনে হতেই পারে, সাধারণ প্রসব যখন এতটাই ভালো যেচেপড়ে লোকে সিজার করান কেন! সে প্রশ্নেরই উত্তর দেব এবার। যে কোনও পদক্ষেপের আগেই তার ভালো দিকের সাথে সাথে মন্দ দিকেরও হদিস থাকা ভালো। নীচে সংক্ষেপে আলোচনা রইল সেই মন্দ দিকগুলো নিয়েই।
নরমাল ডেলিভারির খারাপ দিক
প্রসব বেদনা বা লেবার পেইন (Labour Pain): প্রযুক্তি যতই আধুনিক হোক না কেন, নরমাল ডেলিভারির পথে গেলে প্রসব বেদনা আপনাকে সহ্য করতেই হবে। তাই বলছি, প্রচণ্ড সেই যন্ত্রণা সয়ে নেওয়ার মতো মনের জোর থাকলে তবেই এই পথে হাঁটুন।
মায়ের দুর্বলতা (Mom’s Weakness): ব্য়থা কমানোর কোনও দাওয়াই যেহেতু নেই, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাই প্রসবের পর অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েন নতুন মা। কিছু ক্ষেত্রে নরমাল ডেলিভারিতে রাজি হয়েও ধকলটা না নিতে পেরে শেষমেশ অস্ত্রোপচারের দিকেই হাঁটতে বাধ্য হন তাঁরা।
রক্তক্ষরণ (Blood Loss): ওষুধপত্তর প্রয়োগের বালাই নেই তাই এভাবে প্রসবে রক্তক্ষরণ হয় অনেক বেশি। যার পরিমাণ কখনও ভয়ানক হতে পারে। প্রসব বেদনা দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হলে জ্ঞান হারাতে পারেন মা! এর ফলে প্রসব প্রক্রিয়ার জটিলতা বাড়ে বই কমে না।
সব শেষে তাই এটাই বলব, সেটাই করুন, যেটা আপনার চিকিৎসক আপনাকে করতে বলছেন। আপনার চেয়ে আপনার স্বাস্থ্যের হাল-হকিকত ভালো বুঝবেন তিনি। জেদা-জেদির কোনও প্রশ্নই থাকে না এখানে। সবচেয়ে বড় বিবেচ্য বিষয় হল মা ও গর্ভস্থ সন্তানের ভালো থাকা, সুস্থ থাকা!