গর্ভে থাকার সময় তাঁর সন্তান কি বাইরের জগত সম্পর্কে কিছু বুঝতে পারে? এমন প্রশ্ন অনেক মায়ের মনেই থাকে। অনেকে ভাবেন, জন্মানোর পরেই বুঝি শিশুরা বাইরের জগত সম্পর্কে টের পায়। অনেকে আবার মনে করেন গর্ভে থাকতে থাকতেই শিশুদের বাইরের জগত সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হয়। মহাভারতে যেমন অভিমুন্য সম্পর্কে বলা হয়েছিল। মায়ের গর্ভে থাকার সময় চক্রব্যূহে প্রবেশ করার শিক্ষা সে পায়। (Tips for Bonding With Your Unborn Baby)
পুরাণের কথা যদি বাদও দেওয়া যায়, তা হলেও বলা যায় বিষয়টি অমূলক নয়। বর্তমানে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গর্ভে থাকতে থাকতেই শিশুরা তাদের চারপাশের দুনিয়া সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করে নেয়। গর্ভে থাকা অবস্থায় শিশুদের মধ্যে কোন কোন অনুভূতি জন্ম নেয় তার একটা ধারণা বিশেষজ্ঞরা দিয়েছেন। (Bonding With Your Baby During Pregnancy) দেখে নেওয়া যাক সেই তালিকা।
গর্ভ থেকেই শিশুদের কোন কোন অনুভূতি কাজ করে (What do Babies Experience in Wombs)
- শোনা: গর্ভে থাকতে থাকতেই শিশুরা বাইরের আওয়াজ পেতে শুরু করে। গর্ভে ১৮ সপ্তাহ কাটানোর পর ক্রমশ মায়ের হৃদস্পন্দন বা খাবার হজম হওয়ার শব্দ তারা পায়। ২৬ সপ্তাহ কাটতে না-কাটতেই তারা ক্রমশ মায়ের শরীরের বাইরের শব্দ শুনতে শুরু করে। (Bonding With Your Unborn Baby)
কিন্তু কোনও শব্দ যে পরিমাণে আমাদের কানে পৌঁছয়, গর্ভে থাকা শিশুর কানে তার অর্ধেকেরও কম পরিমাণে পৌঁছয়। জেনে রাখা উচিত, তীব্র কোনও শব্দ গর্ভে থাকা শিশুর কানে পৌঁছলে, সে কেঁদেও উঠতে পারে। তাই তীব্র শব্দ থেকে গর্ভবতী মায়েদের দূরে থাকার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা
- ভাষা শিক্ষা: গর্ভে ৩২ সপ্তাহ কাটানোর পর একটু একটু করে মায়ের ভাষা শুনতে শুরু করে শিশুরা। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, এই সময় থেকেই শিশুরা মায়ের ভাষা শিখে (Language Learning) নিতে শুরু করে।
- স্মৃতিশক্তি: গর্ভে থাকা অবস্থায় যেমন তারা মায়ের ভাষা টের পেতে শুরু করে, তেমনই খুব অল্প পরিমাণে হলেও স্মৃতিশক্তি তৈরি হতে থাকে তাদের। বিশেষ করে কোনও গান যদি নিরন্তর তাদের কানে যায়, তা হলে পরবর্তীকালে সেই গানটি তাদের স্মৃতিতে (Memory) থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। (Bonding With Baby Before Birth)
- দৃষ্টিশক্তি: যদিও জন্মের পরে শিশুদের দৃষ্টিশক্তির বিকাশ হয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জন্মের আগেই গর্ভের মধ্যে একটু একটু করে তাদের দৃষ্টিশক্তি আসতে শুরু করে। ২০ থেকে ২২ সপ্তাহের মধ্যে তাদের রেটিনার প্রাথমিক গঠন সম্পূর্ণ হয়।
- ব্যথার অনুভূতি: ২২ সপ্তাহ গর্ভে কাটিয়ে ফেলার পর শিশুদের অল্প হলেও বেদনার অনুভূতি আসে। ২৬ সপ্তাহ পার করে তারা নিজেদের হাত-পা’ও একটু একটু করে নড়াচড়া করাতে পারে। (Bonding with Baby-to-Be)
নিজের কৌতূহল থেকেই ইন্টারনেট খুলে উপরে লেখা বিষয়গুলো নিয়ে পড়াশোনা করছিল অরুণিমা। অরুণিমা এখন ১২ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা। গর্ভে থাকা শিশুদের অনুভূতির বিষয়ে পড়তে পড়তে ওর মনে হল, তা হলে তো ওর হবু সন্তানেরও এই অনুভূতিরগুলো তৈরি হচ্ছে! আর ছয়-সাত সপ্তাহ পরেই তার মধ্যেও একটু একটু করে আসবে শোনার ক্ষমতা বা স্মৃতিশক্তি
তা হলে কি এখন থেকেই ওর শরীরে যে বড় হয়ে উঠছে, তার সঙ্গে একটা যোগাযোগ বা ‘কমিউনিকেশন’ তৈরি করতে পারে অরুণিমা?
প্রশ্ন নিয়ে সে হাজির চিকিৎসকের কাছে। চিকিৎসক জানালেন, বিষয়টা একেবারেই তাই। আর কয়েক সপ্তাহ পর থেকে অরুণিমা এমন অনেকগুলো কাজ শুরু করতে পারে, যা ভবিষ্যতে ওর সঙ্গে ওর সন্তানের বন্ধন আরও শক্তপোক্ত করবে। (Tips for Bonding With Your Unborn Baby) শুধু তাই নয় চিকিৎসক এটাও জানালেন অরুণিমার বর রাজীবের সঙ্গেও তাদের হবু সন্তানের বন্ধন কী করে আরও শক্তিশালী করে তোলা যাবে।
গর্ভের শিশুর সঙ্গে সংযোগ তৈরি করার রাস্তা (Ways to Bond with Your Baby Bump)
#1. কথা বলুন গান শোনান: মনে রাখবেন, ২৩ সপ্তাহ গর্ভে কাটিয়ে ফেলার পরে শিশুদের মধ্যে একটু একটু করে শোনার ক্ষমতা তৈরি হয়। এই ক্ষমতাকে কাজে লাগান। ওর সঙ্গে কথা বলুন বা আপনার পছন্দের কোনও একটা গান গেয়ে শোনান। এমনভাবে কথা বলবেন বা গান গাইবেন যেন ও ছাড়া আর কেউ শুনতে না-পায়। ইচ্ছে হলে ওকে ছোটদের ছড়াও পড়ে শোনাতে পারেন। (How to Communicate with Your Unborn Baby)
#2. মাসাজ বা মালিশ: তিন মাস কেটে যাওয়ার পর আপনি আপনার পেটে মাসাজ করতে পারেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিন মাস না-কাটার আগে এই মাসাজ বিপজ্জনক হতে পারে। কিন্তু তারপর থেকে খুব অল্প পরিমাণে মাসাজ করা যায়। মাসাজ করাকালীন আপনি আপনার হবু সন্তানের সঙ্গে কথা বলুন। এতে ওর সঙ্গে আপনার একটা সংযোগ তৈরি হবে।
#3. হেঁটে আসুন: দিনের মাথায় রুটিন মেনে অল্প হাঁটাহাঁটি হবু সন্তানের সঙ্গে আপনার খুব সুন্দর একটা বন্ধন তৈরি করে দিতে পারে। চিকিৎসকের থেকে জেনে নিন ,কতটা হাঁটাহাঁটি আপনার জন্য নিরাপদ। তারপর প্রতিদিন নিয়ম মেনে সেই পরিমাণে হাঁটুন। এতে মা এবং সন্তান দু’জনেরই উপকার হবে।
4. ওর নড়াচড়ায় আপনার উত্তর: ১৮ থেকে ২০ সপ্তাহের মধ্যে আপনার সোনা গর্ভের মধ্যে নড়াচড়া শুরু করবে। যখনই সে এমন করছে, তখনই আপনি আপনার পেটে খুব আলতো করে হাত বোলান। (Can Baby Feel When I Rub My Belly) লক্ষ্য করবেন, এমনটা করলে ওই আলতো ছোঁয়ার উত্তরে সে হয়তো আবার হাত-পা ছুঁড়বে। আপনার সন্তানের সঙ্গে সংযোগ বাড়ানোর এর চেয়ে ভালো উপায় খুব কমই আছে।
#5. গোছলের সময়: হবু সন্তানের সঙ্গে বন্ধন শক্তিশালী করার বড় মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে গোছল । যদি বাড়িতে বাথটাব থাকে তা হলে এই পদ্ধতি খুবই কার্যকরী। বেশ খানিকটা সময় আপনি কাটাতে পারেন বাথটাবে শুয়ে। মনে রাখবেন, গরম পানি আপনার সন্তানের জন্য মোটেই ভালো নয়। পাশাপাশি কনকনে ঠান্ডা পানিও ক্ষতিকারক।
হালকা উষ্ণ গরম জলে লম্বা সময় ধরে স্নান করুন। এই সময় আপনার সন্তানের কথা একমনে ভাবুন। পারলে পেটে হালকা মাসাজ করুন। পাশে খুব হালকা আওয়াজে গান চালিয়ে রাখতে পারেন। তবে প্রথম তিন মাস এই কাজ করতে যাওয়া বিপজ্জনক হতে পারে। চিকিৎসকের থেকে জেনে নিন, ঠিক কোন সময় থেকে আপনি বাথটাবে একটু বেশিক্ষণ ধরে স্নান করতে পারবেন।
#6. আপনার সোনার ছবি: চিকিৎসকের কাছে যখন স্ক্যান করাতে গিয়েছিলেন, সেই সময় যন্ত্রে যে ছবি দেখেছেন, পারলে তার একটা প্রিন্ট আউট বের করে নিন। সেই প্রিন্ট আউট আলমারি বা রেফ্রিজারেটর-এর পাল্লায় আটকে রাখুন। বারবার দেখুন ওর ছবিটা। এতে আপনার সঙ্গে আপনার সন্তানের বন্ধন আরও পোক্ত হবে। (Ways to Bond with Your Unborn Baby)
তবে শুধুমাত্র মায়েরাই কেন, বাবারাও পারেন তাঁদের হবু সন্তানের সঙ্গে সংযোগ বাড়াতে। তার জন্যও পথ বাতলে দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। রইল সেই বিষয়ের টিপস-ও।
বাবা কীভাবে সংযোগ তৈরি করবেন? (How Dads Can Bond With the Babies)
- যখন সময় পাবেন বাবারাও অল্প মাসাজ করে দিন মায়েদের পেটে। এতে হবু সন্তানের সঙ্গে বাবাদের একটা সংযোগ তৈরি হবে।
- চিকিৎসকরা যেমন মায়েদের পরামর্শ দিচ্ছেন হবু সন্তানের সঙ্গে কথা বলতে বা তাদের গান গেয়ে শোনাতে, তেমনই বাবাদের জন্যও তাঁদের একই পরামর্শ। খুব নিচু স্বরে কথা বলুন আপনার হবু সন্তানের সঙ্গে বা তাকে আপনার পছন্দের গান গেয়ে শোনান। (How Dad Can Born with Unborn Baby)
- আপনার হবু সন্তান যখন তার মায়ের পেটে হাত-পা ছুঁড়ছে, তখন মা যেমন বাইরে থেকে স্পর্শ করে সাড়া দিতে পারেন, তেমনই পারেন বাবারাও। এই সব মুহূর্তগুলো আপনার সন্তানের সঙ্গে বন্ধন তৈরি করার কাজে লাগান। (Father Bonding with Baby Before Bath)
সবচেয়ে বড় কথা, মা যখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন বা নিজের পেটের স্ক্যান করাবেন, তখন বাবাও যেন সেখানে উপস্থিত থাকেন।
অরুণিমা আর রাজীব চিকিৎসকের কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে ঠিক করে নিল ওদের পদক্ষেপ। ওরা এখন জানে, যখন ওদের সন্তান পৃথিবীর আলো দেখবে, তার অনেক আগে থেকেই সে টের পেয়ে যাবে বাবা-মা তাকে কতটা ভালোবাসে।