থাইরয়েড প্রজাপতির মতো আকৃতির ছোট একটি গ্রন্থি, যা আমাদের গলার সামনের দিকে থাকে। এই থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে থাইরক্সিন নামের একটি হরমোন নিঃসরণ হয় এবং এই হরমোন রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে আমাদের শরীরে প্রতিটি কোষে কোষে পৌঁছে যায়। এই থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোন শুধুমাত্র যে আমাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের কার্যকারীতা নিয়ন্ত্রণে অংশ নেয়, তাই নয়; আমাদের শরীরের পাচনক্ষমতা, তাপমাত্রা এবং হৃদযন্ত্রের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণেও গুরুত্বপূর্ণ অংশ নেয়। অনেকক্ষেত্রে এই থাইরয়েড গ্রন্থি কম বা বেশি হরমোন তৈরি করে ফেলে। থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি পরিমাণে হরমোন নিঃসরণ হলে তাকে হাইপারথাইরয়ডিজম (hyperthyroidism) এবং কম নিঃসরণ হলে তাকে হাইপোথাইরয়ডিজম (hypothyroidism) বলা হয়। যেসব মহিলারা হাইপারথাইরয়ডিজম বা হাইপোথাইরয়ডিজম রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন এবং সঠিক চিকিৎসা না করিয়ে তা অগ্রাহ্য করেন, তাদের কনসিভ করার ক্ষেত্রে এবং প্রেগন্যান্সিতে নানারকম সমস্যা দেখা যায়। শরীরে থাইরয়েড গ্রন্থির খামখেয়ালীপনার কারণে মহিলাদের শরীরে কী কী অসুবিধা দেখা দিতে পারে এবং তার জেরে প্রেগন্যান্সিতে কী প্রভাব পড়তে পারে, দেখে নিন একনজরে।
গর্ভকালীন থাইরয়েডের সমস্যা ও করণীয়
- হাইপারথাইরয়ডিজমের উপসর্গ (Signs of hyperthyroidism)শরীরের তাপমাত্রা বেশি বোধ করা।
- খিটখিটে মেজাজ এবং অকারণ উদ্বেগ।
- শারীরিক মিলনে অনীহা।
- বারবার খিদে পেলে বা খেলেও ওজন কমে যাওয়া।
- বুক ধড়ফড় করা এবং পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া।
- রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া এবং অস্থিসন্ধিতে ব্যথা হওয়া।
- চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসা ও অতিরিক্ত ক্লান্তভাব।
- ত্বক কালো হয়ে যা সনাক্ত করা গেলে এই রোগ চিকিৎসার মাধ্যমে সারিয়ে তোলা যায়।
হাইপোথাইরয়ডিজমের উপসর্গ (Signs of hypothyroidism)
- ওজন হঠাৎ বেড়ে যাওয়া।
- রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া এবং অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ।
- ত্বক শুকনো হয়ে যাওয়া।
- খাবারে অরুচি এবং খিটখিটে মেজাজ।
- শীতের প্রতি সংবেদনশীল হয়ে পড়া।
- পায়ে জল জমা, চুল পড়ে যাওয়া এবং কোষ্ঠকাঠিন্য।
- পেশি শিথিল হয়ে যাওয়া ও শারীরিক মিলনে অনীহা
হবু মা হাইপারথাইরয়ডিজম বা হাইপোথাইরয়ডিজমে আক্রান্ত হলে কনসিভ করার ক্ষেত্রে বা গর্ভস্থ সন্তানের ওপর কী প্রভাব পড়ে? ।
- হাইপারথাইরয়েডিজমের সঠিক চিকিৎসা না হলে বা গর্ভাবস্থায় থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিক না থাকলে, আকস্মিক গর্ভপাতের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
- হাইপোথাইরয়ডিজমের কারণে গর্ভস্থ শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং শিশু কম IQ নিয়ে জন্মাতে পারে।
- থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা অস্বাভাবিক হলে নির্দিষ্ট সময়ের আগে প্রসব হতে পারে বা মৃত সন্তান জন্ম নিতে পারে।
- প্রি-এক্লাম্পশিয়ার ঝুঁকি অনেকংশে বেড়ে যায়।
- দুই ক্ষেত্রেই বাচ্চা গর্ভে ঠিকভ
গর্ভাবস্থায় থাইরয়েড সচেতনতা অপরিহার্য (Thyroid Disease And Pregnancy: Things You Need to Know)
- যদি আপনি ওপরে উল্লিখিত উপসর্গগুলি নিজের শরীরে লক্ষ্য করছেন বা আপনার নিকটাত্মীয়ের মধ্যে কেউ থাইরয়েড জনিত রোগে আক্রান্ত, তাহলে সজাগ হোন।আপনি কনসিভ করার প্ল্যান করুন বা না করুন,আপনার নিজের শারীরিক জটিলতা এড়ানোর জন্যও এই থাইরয়েডকে স্বাভাবিক রাখা খুব দরকার। কোনও রকম অসুবিধা লুকিয়ে বা চেপে না রেখে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
- যদি আপনি কনসিভ করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত, তা হলে নিশ্চিন্তে থাকার জন্য ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে প্রয়োজনীয় কিছু রক্তপরীক্ষা করিয়ে নিন। এর ফলে, আপনি থাইরয়েড হরমোনজনিত কোনও সমস্যায় আক্রান্ত হলে তা আগেই ধরা পড়ে যাবে এবং আপনি প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শুরু করতে পারবেন। থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিক না হলে, কনসিভ করতেও অনেক সমস্যা হয় আবার কনসিভ করার পরে আকস্মিক গর্ভপাতের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। যদি আপনি আগে থেকেই থাইরয়েডের জন্য ওষুধ খাচ্ছেন, তা হলে সেটা আপনার ডাক্তারকে জানান। প্রেগন্যান্সি চলাকালীন চিকিৎসা করতে এতে আপনার ডাক্তারের সুবিধা হবে। প্ল্যানিং শুরু করার আগে, রক্তপরীক্ষা করিয়ে থাইরয়েড হরমোন স্বাভাবিক মাত্রায় আছে কি না, দেখে নিন এবং একজন হরমোন বিশেষজ্ঞেরও পরামর্শ নিয়ে নিন।
- প্রেগন্যান্সির প্রথম তিন মাস ভ্রূণের বিকাশ নির্ভর করে মায়ের থাইরয়েড গ্রন্থি নিঃসৃত হরমোনের ওপর। এই হরমোন গর্ভস্থ ভ্রূণের মস্তিষ্কের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অংশ গ্রহণ করে। তাই শিশু যাতে মায়ের শরীর থেকে পর্যাপ্ত থাইরয়েড হরমোন পায়, সেদিকে নজর রাখা উচিত। কনসিভ করার পরে মায়ের শরীরে যেসব হরমোন উৎপাদনকারী গ্রন্থি শিশুর বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ, তার মধ্যে থাইরয়েড অন্যতম। গর্ভধারণের প্রথম দিকে মায়ের সাথে সাথে শিশুর চাহিদা মেটাতে বেশি থাইরয়েড হরমোন প্রয়োজন, গর্ভাবস্থার শেষের দিকে এই হরমোনের চাহিদা প্রায় ৫০% বেড়ে যায় এবং থাইরয়েডের ঘাটতিজনিত সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
- গর্ভাবস্থায় অনেক মা ক্লান্তি বোধ করেন,হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে যাওয়া অনুভব করেন। অনেক ক্ষেত্রেই গর্ভাবস্থার সঙ্গে জড়িত অন্যান্য শারীরিক উপসর্গগুলি থেকে থাইরয়েডের সমস্যা আলাদা করে বোঝা যায় না। এজন্য, নিয়মিত ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে থাকা প্রয়োজন।
- নিয়মিত চিকিৎসায় থাকলে মা ও গর্ভস্থ সন্তানের ভয়ের কোনও কারণ থাকে না। মা যদি নিয়মিত ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে থাকেন এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ওষুধ খান, তা হলে থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিক থাকে। এক্ষেত্রে গর্ভের সন্তানের বিকাশেও কোনও বাধা সৃষ্টি হয় না এবং সম্পূর্ণ সুস্থ সন্তান জন্ম গ্রহণ করে।
- জন্মের পর শিশুর শরীরে যদি থাইরয়েড জনিত কোনও সমস্যা দেখা যায়, তা হলে সঙ্গে সঙ্গে তার চিকিৎসা করানো প্রয়োজন। এছাড়াও যেসব মায়েরা নিয়মিত থাইরয়েডের ওষুধ খান, তারা বাচ্চাকে অবশ্যই বুকের দুধ খাওয়াবেন কিন্তু নিয়মিত বাচ্চাকে ডাক্তারের কাছে পরীক্ষা করাতে ভুলবেন না।
- কখনও কখনও প্রসবের তিন মাস পরে মা পোস্ট পারটাম থাইরয়েডাইটিসে ভুগতে পারেন। এক্ষেত্রে প্রথমে অস্থায়ী হাইপোথাইরয়েডিজম হয় এবংপরবর্তী ক্ষেত্রে হাইপারথাইরয়েডিজম হয়।