একটি সন্তানের দায়িত্ব বাবা-মা দুইজনেরই সমান। মায়ের দায়িত্ব শুরু হয় বাচ্চা গর্ভে ধারণের মাধ্যমে, আর বাবার দায়িত্ব শুরু হয় তার গর্ভবতী স্ত্রীর যত্ন নেয়ার মাধ্যমে। আমাদের দেশে স্বামীদের মধ্যে এখনও গর্ভবতী স্ত্রীর যত্নের ব্যাপারটা ঐভাবে আসেনি। অনেকে জানেনই না, এই সময়ে মেয়েদের মানসিক এবং শারীরিক কি কি পরিবর্তন আসে। হাসিখুশি মেয়েটা কেন কথায় কথায় কেঁদে ফেলে অথবা একদম শান্ত মেয়েটা কেন ছোটখাটো ব্যাপারে রেগে মেগে একাকার হয়, তার সঙ্গীর জন্য এটা বের করাও কম কঠিন কাজ না। গর্ভবতী স্ত্রীর প্রতি আপনার কি মনোভাব হওয়া উচিত, সেটা নিয়েই এই লিখাটি-
১) প্রেগনেন্সি নিয়ে জানতে হবেঃ প্রেগনেন্সি মানে শুধু বাচ্চা গর্ভে ধারণ আর প্রসব করা না, বরং এর বাইরে আরও অনেক অনেক অভিজ্ঞতা যা একটা মা পুরো সময়টা জুড়ে তার শরীরে অথবা মনে ধারণ করে, সেটা তার সঙ্গী কে বুঝতে হবে। একেক মায়ের শরীর একেক রকম। গর্ভবতী হলে বিভিন্ন হরমোনের পরিবর্তনে শরীর ভিন্ন ভাবে সায় দেয়, তাই এটা আগে থেকে বলা মুশকিল যে ঠিক কি কি পরিবর্তন আসবে। কিন্তু জেনে রাখা ভালো যে এই পরিবর্তনগুলো অবশ্যম্ভাবী। তাই স্ত্রী গর্ভবতী হওয়ার সাথে সাথে, অথবা আগে থেকেই এই বিষয়ে পড়াশুনা করে জেনে নেয়া ভালো। তাহলে একজন যত্নবান সঙ্গী হিসাবে আপনি একদম প্রস্তুত থাকবেন। সে ক্ষেত্রে আপনি বইয়ের সাহায্য নিতে পারেন, অথবা ইন্টারনেটেই পাবেন অনেক অনেক তথ্য। তাই এই লেখার প্রথম টপিকই হচ্ছে ‘জানতে হবে'।
২) স্ত্রীর সঙ্গে ডাক্তারের কাছে যাওয়াঃ গর্ভবতী অবস্থায় খুব ঘন ঘন ডাক্তারের কাছে যেতে হয় রুটিন চেকআপে, অথবা কোন জরুরি অবস্থায়। আর অনেক প্যাথলজিকাল টেস্টের মধ্যে দিয়েও যেতে হয়। ডাক্তারের কাছে অপেক্ষা থেকে শুরু করে আসা যাওয়ার সময়টা অনেক সময়ই গর্ভবতীর কষ্টের কারণ হতে পারে। একজন আদর্শ সঙ্গীর উচিত এই সময়গুলোতে স্ত্রীকে সঙ্গ দেয়া। আপনার যদি কোন কাজও থাকে, সেটাকে পিছিয়ে হলেও আপনার স্ত্রীর সাথে ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত। এভাবে আপনি আপনার সঙ্গী কে আশ্বস্ত রাখতে পারবেন যে আপনিও তার সাথেই আছেন।
৩) সঙ্গীর মানসিক অবস্থা বুঝে চলা, এবং সেটায় কোন প্রতিক্রিয়া না দেখানোঃ আগে যত বছর ধরেই আপনার সঙ্গী কে চিনে থাকুন না কেন, গর্ভবতী অবস্থায় সম্ভাবনা খুব বেশি যে তাকে আর আগের সাথে মিলাতে পারবেন না। বিভিন্ন হরমোনাল পরিবর্তনে তিনি কিভাবে বদলান সেটাও বলা মুশকিল। কিন্তু সেটা বুঝে চলাই আপনার মূল কাজ হবে এই কয়দিন। বুঝতে হবে এই অবস্থা সাময়িক। তাই খুব বেশি প্রতিক্রিয়া না করে তাকে বুঝার চেষ্টা করুন এবং ভালবাসার সাথে সেটা মোকাবেলা করুন। সহনশীলতা-ই এখানে মূল সমাধান। যেকোনো পরিস্থিতি তে মাথা ঠাণ্ডা রেখে মুখের হাসি ধরে রাখলেই অনেককিছু সহজ হয়ে যাবে।
৪) স্ত্রীর যত্ন নিনঃ স্ত্রীর বিভিন্ন প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া যত্নের মধ্যে পড়ে। এই সময় খাওয়া দাওয়ার দিকে বিশেষ নজর দিতে হয়। তাই দৈনন্দিন খাবারে আপনার স্ত্রী ঠিক পুষ্টি পাচ্ছে কিনা সেটা দেখার দায়িত্ব আপনার। প্রেগনেন্সিতে অনেক কিছু খেতে ইচ্ছা করে গর্ভবতীর, মাঝে মাঝে সেই ইচ্ছাটা উদ্ভট সময়ে উদ্ভট ধরনের হয়, চেষ্টা করতে হবে যাতে সেই আবদার সেই সময়ই মেটানো হয়। স্ত্রীর পছন্দের খাবার রান্না করা, তাকে পছন্দের রেস্টুরেন্ট এ নিয়ে যাওয়া, বিভিন্ন উপহার দেয়া- এইসব হতে পারে কিছু উদাহরণ কিভাবে আপনার স্ত্রীকে ভালো অনুভব করাতে পারেন গর্ভাবস্থায়। এছাড়া শরীর স্ফীত হলে প্রেগনেন্সিতে অনেক দৈনন্দিন কাজই আগের মতন আর করা যায়না, তাই যতটা সম্ভব সেইসব কাজে সাহায্য করতে হবে।
৫) স্ত্রীর শারীরিক পরিবর্তন কে স্বাভাবিকভাবে নিনঃ নিজের শরীরের ভিতর আরেকটা শরীরকে বড় করতে খুব জটিল সময়ের মধ্যে যেতে হয়। তখন বাচ্চার জন্য হোক, অথবা নিজের শারীরিক শক্তি বজায় রাখতে হোক- মায়েদের এই সময়ে পরিমানে আগের তুলনায় বেশি খেতে হয়। শুধু খাওয়া না, নানান কারনেই এই সময় মায়েদের ওজন বাড়ে। অনেক সময় মায়ের নিজের কাছেই নিজেকে দেখতে ভালো লাগেনা। একজন সাপোর্টিভ সঙ্গী হিসাবে আপনার উচিত আপনার স্ত্রী কে আশ্বস্ত করা যে এটাই স্বাভাবিক। এবং কোনভাবেই তার ওজন, বা বদলে যাওয়া শারীরিক অবয়ব নিয়ে ব্যাঙ্গ করা ঠিক হবেনা। অন্য কেউ ও যদি এসব নিয়ে কিছু বলে, তবে সেটার প্রতিবাদও আপনার করতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে আপনার বুঝতে হবে আপনার সন্তানকেই পৃথিবীতে আনতে আপনার স্ত্রী এতকিছুর মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তাই এইসব ব্যাপার যেখানে আপনার স্ত্রীর কোন হাত নেই, সেইসবে কটূক্তি করা করা উচিত নয়।
৬) আপনার শিশুর কেনাকাটায় সঙ্গী কে সঙ্গ দিনঃ অনাগত সন্তান কে স্বাগতম জানাতে ঘর সাজানো থেকে শুরু করে, কাপড় চোপড়, প্রসাধনী অনেক কিছুই কিনতে হয় বাচ্চা হওয়ার আগেই। এবং প্রতিটা মায়ের জন্যই এই ব্যাপার টা খুব মধুর। বাবা হিসাবে আপনারও এইসব বিষয়ে আগ্রহী হওয়া উচিত। যাচাই করে দেখা উচিত কোন জিনিসটা ভালো, কিভাবে ব্যবহার করা যায়। এতে আপনার স্ত্রী বুঝতে সক্ষম হবে আপনিও সমান ভাবে উত্তেজিত আগামী দিনগুলালোকে স্বাগতম জানানোর জন্য।
৭) হাসপাতালের ব্যাগ গুছাতে সাহায্য করুন এবং ডেলিভারিতে তাকে সঙ্গ দিনঃ হাসপাতালের ব্যাগে কি কি নিতে হবে সেটা আগে থেকে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জেনে নিন। ইন্টারনেটে অনেক ভালো ভালো ব্লগ আছে এই ব্যাপারে। আপনার স্ত্রী ডেলিভারির পর যথেষ্ট ক্লান্ত আর অসুস্থ থাকতে পারেন, তাই ব্যাগে কোথায় কি রাখা আছে ভালমত জেনে নিন যাতে ঠিক সময়ে দ্রুত আপনি প্রয়োজনীয় জিনিসটা বের করতে পারেন। সম্ভব হলে আপনি নিজের হাতেই গুছান। আর বাংলাদেশে এখন কিছু হাসপাতালে ডেলিভারির সময় স্বামী কে থাকতে দেয়া হয়। সম্ভব হলে ডেলিভারির সময় আপনার স্ত্রীর সাথেই থাকুক, তার আগে নরমাল ডেলিভারি এবং সি-সেকশন নিয়ে পড়াশুনা করে নিন, এবং আপনার করনীয় ব্যাপারগুলা সম্পর্কে জেনে নিন। শারীরিক ভাবে যদিও একজন মেয়েই গর্ভবতী হন, কিন্তু আপনাকে ভুললে চলবেনা এই যাত্রায় আপনি তার সঙ্গী। আপনার দায়িত্ব গুলো আপনি সুন্দর ভাবে পালন করলে আপনার স্ত্রীও মানসিক ভাবে নিশ্চিন্ত থাকবেন। এবং একটি সুন্দর পরিবেশে আপনার অনাগত সন্তানটি ও বেড়ে উঠবে নির্বিঘ্নে!
লেখিকা- তাজী শারমিন মমতাজ।