সন্তান পালনের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের ৫ টি ভুল ধারণা

অভিভাবক হিসাবে আমরা সবসময় সন্তানদের ভালোটাই চাই। আমাদের সমস্ত চিন্তায়, সব কাজে চেষ্টা করি সন্তানদের জন্য ভালো কিছু করার। শিশুকে বড় করার ক্ষেত্রে আমরা বাবা-মা এবং অভিভাবকরা কিছু পুরনো ধারণাকে সত্যি বলে মনে করি যেগুলো আধুনিক গবেষণায় নানাভাবে ভুল প্রমানিত হয়েছে। এরকম ৫ টি ভুল ধারণাকে কেন্দ্র করে আজকের লিখাটি-

১। শিশুকে শাস্তি বা ভয় দেখালে সত্যি বলবে

সাধারণত ৩-৪ বছর বয়সে শিশুরা মিথ্যা বলতে শিখে যায়। প্রথম মিথ্যা বলাটা একটি শিশুর জন্য অন্যরকম একটি অভিজ্ঞতা। সাধারনত শিশুরা মিথ্যা বলে বাবা-মাকে খুশি করার জন্য অথবা শাস্তি এড়ানোর জন্য। একটি শিশু একটি কাঁচের জিনিস ভেঙ্গে ফেললে যদি আপনি তাকে শাস্তি দেন, তাহলে পরবর্তীতে সেই শাস্তি এড়ানোর জন্য সে মিথ্যা বলবে। অনেক অভিভাবকরা মনে করেন শিশুদের শাস্তি দিলে বা ভয় দেখালে সে সত্যি কথা বলা শিখবে। মিথ্যা বললে আল্লাহ গুনাহ দিবে, জাহান্নামে যেতে হবে – এই ভয়গুলোও দেখানো হয় অনেক সময়। কিন্তু মাত্র ৩-৪ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে এখনও সৃষ্টিকর্তা, পরকাল এই বিষয়গুলো অনুধাবন করার মত মানসিক বিকাশ হয়নি। কোনও শিশু যদি কোনও ভুল করেই ফেলে তাকে বলুন, আপনি বেশি খুশি হবেন যদি সে সত্যি কথাটি বলে। মিথ্যা বলা অনেক সময় অন্যের ক্ষতি হতে পারে সেটা তাকে উদাহরণের মাধ্যমে বুঝাতে হবে।

২। প্রশংসা করলে শিশুর আত্মবিশ্বাস বাড়ে

আপনার শিশু একটা অংক নিজে সমাধান করে ফেলতে পারলে, বা কোনও একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিতে পারলে যখন আপনি বলেন, ‘ওয়াও, তুমি তো খুব বুদ্ধিমান’, তখন আপনি আপনার সন্তানকে যে সিগন্যালটি দিচ্ছেন তা হল- নিজেকে বুদ্ধিমান প্রমাণ করার জন্য যেকোনো মূল্যে ভুল পরিহার করতে হবে। এরপর থেকে শিশুরা কিছুটা কঠিন জিনিসও আর করার চেষ্টা করে না। কেবল সে নিজে যেগুলো পারে সেগুলোই করতে চাবে। এটি শিশুকে পরিশ্রম করে কোনও কিছু সমাধানে নিরুৎসাহিত করে। তার চেয়ে বলুন, আপনি সত্যি খুশি হয়েছেন বা আপনার সত্যি ভালো লেগেছে তার পরিশ্রম করে ব্যাপারটা সমাধানের চেষ্টাকে। চেষ্টাকে উৎসাহিত করুন, সফলতাকে নয়। অনেক সময় বাচ্চার ভুলও হতে পারে। কিন্তু তার করার চেষ্টাকে আনুপ্রানিত করুন। এতে করে সে যেকোনো সমস্যা/চ্যালেঞ্জ নিজে থেকে সমাধানের চেষ্টা করবে। কোনও সমস্যা বা চ্যালেঞ্জকে পাশ কাটানোর চেষ্টা ওর মধ্যে থাকবে।

৩। প্রতিভাধর শিশুদের ৫ বছর বয়সের মধ্যেই চিহ্নিত করা যায়

বাবা-মাদের মধ্যে একটি প্রতিযোগিতার মত আছে নিজের সন্তানকে প্রতিভাধর হিসাবে জাহির করার জন্য। আত্মীয়স্বজন কেউ বাসায় আসলে সন্তানকে ডেকে ডেকে তার আঁকা ছবি, কবিতা বা গান গাইতে বলা হয়। স্কুলে ভর্তি করার পর থেকেই প্রথম এক দুই ক্লাসে উপরের দিকে থাকলেই মনে করা হয় সন্তান অত্যধিক প্রতিভাধর। পরবর্তীতে যখন কয়েকবছর পর সেইসব শিশুদের ক্লাস পজিশন নিচের দিকে নামতে থাকে তখন বাবা-মায়ের কষ্ট আর দেখে কে? ব্যাপার হল এই যে, কিন্ডারগার্ডেন লেভেলে যে শিশুরা ক্লাসের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিভাবান হিসাবে চিহ্নিত হয় তার মধ্যে মাত্র ২৭ ভাগের কপালে লেভেল ৩ পর্যন্ত ‘প্রতিভাবান’ তকমা থাকে। কেবল হয়ত টপ ১% শিশু ৫ বছর পর ক্লাসের টপ ১০% এর মধ্যে থাকে। দয়া করে তাই অল্প বয়সেই শিশুদের গায়ে ‘বাচ্চা আইনস্টাইন’ তকমা লাগিয়ে দিবেন না। এতে করে শিশুটির উপর মানসিক চাপ তৈরি হয় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আপনিও হতাশ হবেন যখন দেখবেন শিশুটি ততই ‘অ-আইনস্টাইন’ হয়ে যাচ্ছে। ও আচ্ছা, আইনস্টাইন নিজেও কিন্তু ছোটবেলায় ক্লাসের ‘বোকাসোকা ছাত্রই ছিলেন।

৪। শিক্ষামূলক কার্টুন এবং ভিডিও সন্তানকে স্মার্ট বানায় না

৩ বছর বয়সের আগে কোন শিশুকে স্মার্টফোন, ট্যাব ইত্যাদি হাতে দেয়াই উচিত না। বড়জোর কিছুটা কার্টুন দেখতে দিতে পারেন। শিক্ষামূলক কার্টুন বা ভিডিওগুলো শিশুদের কেবল একমুখী শিক্ষার দিকে ধাবিত করে। এই বয়সে কেবল চোখে দেখা হয়, বরং তার সবগুলো ইন্দ্রিয় কাজে লাগে এমন কাজে অংশগ্রহণ করানো উচিত। আর এই ভিডিওগুলোর রঙ, ক্যারেক্টারের নাড়াচাড়া এইসব আসলে শিশুদের আকৃষ্ট করে, শিক্ষামূলক কিছু না। এত দ্রুত সবকিছু পরিবর্তন হয় যে শিশুদের পক্ষে তা বিশ্লেষণ করে বুঝে উঠা সম্ভব না। শিশুদের প্রসেসর আমাদের বয়স্কদের থেকে একটু ধীরগতির।

৫। শিশুকে যেকোনও মূল্যে বুলিং (Bullying) থেকে রক্ষা করতে হবে, কারণ এটি সন্তানের মানসিক বিকাশে খুব ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে

আমাদের দেশে হয়তো এখনও আমাদের বাবা-মারা এই বিষয়টি নিয়ে তেমন মাথা ঘামান না। কিন্তু পাশ্চাত্যর দেশগুলো যেমন আমেরিকাতে এটি নিয়ে ব্যাপক তোড়জোড় চলে সবসময়। গাদাগাদা রিসার্চ হয়, প্রতি বছর হাজার হাজার নতুন প্রোগ্রাম চালু হয় স্কুলগুলোতে বুলিং নিয়ে সচেতনতা তৈরির জন্য। আজকাল অবশ্য আমাদের দেশেও ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর বাবা-মাদের সাথে আলোচনায় এই বিষয়টিও উঠে এসেছে আমাদের কাছে। কিন্তু গত কয়েকবছর বেশ কিছু রিসার্চে দেখা গেছে আসলে বুলিং ব্যাপারটা তেমন ভয়ংকর না যতটা আমরা বাবা-মায়েরা ভাবি। একটি ছোট শিশুর বেড়ে উঠার এবং সমাজের সাথে মানিয়ে চলার দক্ষতা তৈরির একটি জায়গা হল স্কুল। সেখানে বড় ক্লাসের ছাত্রছাত্রী একটু বকা দিল, ক্লাসের একটি ছেলে একটা গালি দিল বা চিমটি কাটল, খেলাতে নিলো না – এসবই একটি শিশুর বেড়ে উঠার সামাজিক ধাপ। এগুলোকে আপনি কখনই শতভাগ এড়াতে পারবেন না, এড়ানোর চেষ্টাও করবেন না। জীবন কখনই এত মসৃণ না। এই ছোট ছোট বুলিং আপনার সন্তানকে মানসিকভাবে শক্ত করবে, নিজের সমস্যা নিজে সমাধানের চেষ্টা করবে।

তবে অবশ্যই খেয়াল রাখবেন বুলিং যেন কখনই খুব খারাপ দিকে মোড় না নেয়। মারামারি করা, একঘরে করে দেয়া – এসব ক্ষেত্রে নিজে উদ্যোগ নিন। আর ছোট বড় যেকোনো বুলিং নিয়ে সন্তানের সাথে খোলামেলা কথা বলুন। তাকে মানসিকভাবে সাপোর্ট দিন।

ToguMogu Logo

ToguMogu is a parenting app offering essential support from family planning to raising children up to age 10.

ToguMogu

Contact

  • +88 01958636805 (Customer Care)
  • [email protected]
  • Rezina Garden, House 67/A, Road 9/A, Dhanmondi, Dhaka 1209, Bangladesh

Copyright © 2025 ToguMogu All rights reserved.